নৃত্যে বেশ ভূষা ও
রূপ সজ্জার প্রয়োজনীয়তা
-লাভলী কোরেশী
নৃত্যে রূপসজ্জা একটি বিশেষ অঙ্গ। মানুষ যখন প্রথম জ্ঞান বৃক্ষের ফল খেল, তখন থেকে আরম্ভ তার দেহকে সজ্জিত করবার চেষ্টা। সেই অন্ধকারময় যুগে বৃক্ষের বা কল অথবা পাতা দিয়ে অঙ্গ আবৃত করে মানুষ লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করত। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে চলল নিজের দেহকে সজ্জিত করে অপরের চোখে সুন্দর করবার প্রয়াস। আজ পর্যন্ত এই প্রয়াসের বিরা মা নেই। নিজেকে পুরুষের চোখে অপরূপা করে তোলাই নারীর ধর্ম। নারী বিশ্ব প্রকৃতির প্রতীক। বিশ্ব প্রকৃতির মত নব নবরূপ সজ্জায় নিজেকে সজ্জিত করা নারীর প্রকৃতি গত স্বভাব। সুতরাং নৃত্যেও রূপসজ্জার সার্থকতা হচ্ছে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে দর্শকের মন হরণ করা। সেই জন্যে প্রাচীন নাট্যশাস্ত্র কাররা নৃত্যে রূপসজ্জাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
নৃত্যে বিভিন্ন মুদ্রা, আখ্যান বস্তু, মুখের অভিব্যক্তি, মঞ্চ সজ্জা প্রভৃতিরস সৃষ্টির জন্য যেমন একান্ত প্রয়োজন, সেই প্রকার উপযুক্ত বেশভূষাও সার্থক রস সৃষ্টিতে সাহায্য করে। তাই প্রাচীন কাল থেকেই আমরা নৃত্যের একটি বিশেষ অঙ্গরূপে দেখতে পাই বেশভূষা ও রূপসজ্জাকে।
নৃত্যানুষ্ঠানের মঞ্চে প্রথম দর্শনেই যদি শিল্পী দর্শকদের মনকে তার দিকে আকৃষ্ট করতে না পারেন তাহলে তার নৃত্যশৈলী প্রদর্শন শ্রোতাদের চিত্তহরণ করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই শোম্যানশিপটা নৃত্য শিল্পীদের মঞ্চানুষ্ঠানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মঞ্চ সজ্জা, নেপথ্য সংগীত প্রভৃতির সাথে শিল্পীর বেশভূষা ও রূপ সজ্জা দর্শকদের চিত্তাকর্ষণের জন্য খুবই প্রয়োজন। রূপসজ্জার ক্ষেত্রে অধিক ‘মেকাপ’ করা অর্থাৎ অধিক পাউডার বা অধিকরু জলা গান যেমন উচিত নয়, তেমনি আবার বেশভূষার ক্ষেত্রেও জমকালো পোষাক পরিধান করা উচিত নয়। কারণ এতে শিল্পীর ব্যক্তিত্ব ও প্রদর্শন কৃতিকে আছন্ন করে রাখে। বর্তমানে বিভিন্ন নৃত্যশৈলীতে যে সকল রূপসজ্জার প্রচলন আছে, তা ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যকে যথাযথ অনুসরণ করে না। দেশভেদে, কালভেদে ও আচার ভেদে রূপসজ্জা ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়েছে।
নৃত্যে ও এই একই উদ্দেশ্য অর্থাৎ দর্শকদের মন হরণ করবার জন্য নব নব রূপ সজ্জায় শিল্পী নিজেকে সজ্জিত করতে লাগল। একই কারণে প্রাচীন নাট্যশাস্ত্র কার রাকি নৃত্যে, কি অভিনয়ে রূপ সজ্জাবেশ ভূষার যথাযথ ব্যবহার সম্বন্ধে নির্দেশ দিয়েছেন। সৌন্দর্য সৃষ্টি ছাড়াও রস সৃষ্টির জন্যও বেশভূষা বা রূপ সজ্জার প্রয়োজন রয়েছে সে কথা আগেই বলা হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন নৃত্যশৈলীর আলোচনা করলে দেখা যায় যেও ইসকল নৃত্যের নানা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রূপসজ্জা বা বেশভূষার বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণীয়।
নৃত্যে বেশভূষা অবশ্যই আধুনিক রুচিসম্মত হওয়া উচিত তবে তা অশ্লীলতা বর্তমানে। এমন পোশাক পরিচ্ছদ নৃত্যে ব্যবহার করতে হবে যাতে নৃত্য করবার সময় শিল্পীর কোন অসুবিধা না হয়। পোশাকের রঙ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও শিল্পীকে সর্বদা সচেতন হতে হবে। কারণ সব রংসব ক্ষেত্রে মানায় না, আবার সবাইকে সবরং মানায় না।
সুতরাং সুরুচিপূর্ণ সুন্দর সভ্য পোশাক পরিধান করতে হবে নৃত্যশিল্পীকে। যেমন মণিপুরী নৃত্যে শ্রীকৃষ্ণের পীতবসন, খাওন, কোমরে গুঙ্গা, চিরংনাখুম, মাথায়চূড়া, কালোভেল ভেটের টুপী, নূপুর ইত্যাদি পোশাক ব্যবহৃত হয়। আবার মেয়েরা বড় ঘাঘরা, পোষওয়ান ব্লাউজ, ওড়না, খাপন, গুঞ্জা ইত্যাদি পরিধান করেন। এইবেশ ভূষা তথা পোশাক পরিচ্ছেদের দ্বারাই মণিপুরী নৃত্যের কামনীয়তা ও লাবণ্য পরিস্ফুট হয়। আবার কথা কলি নৃত্যে পুরুষেরা বালু, উডুতুকেট, উত্তরীয়, কল্যারম পরিধান করেন এবং মাথায় কিরীটি, মুন্ডী, গলায় কাড়ি তুহারম পরিধান করেন। নারীরা শাড়ী, ওড়না, বেল্টপরিধান করেন। কথাকলি নৃত্যশিল্পীরা চরিত্র ও রস অনুযায়ী মুখে রং ব্যবহার করেন। তারা চরিত্র অনুযায়ী মুখোশের ব্যবহার করে থাকেন। এই পোশাক ও রূপসজ্জার দ্বারা বোঝা যায় যে এটি কথা কলিনৃত্য। কারণ এইবেশ ভূষা ও রূপসজ্জা অন্যকোন নৃত্য পদ্ধতিতে পাওয়া যায় না। কত্থক নৃত্যে আবার লক্ষৌ ঘরাণাতে পুরুষেরা পাজামা, আচকান, জদ্রি, টুপী পরিধান করেন এবং নারীরা বেশী ঘেরের কোট ফ্রক, ওড়না, মাথাতে সিঁথি বাঝাপটা পড়েন। জয়পুর ঘরাণাতে পুরুষেরা চোস্ত পাজামা, আচকান ও টুপী পরিধান করেন এবং নারীরা চোস্ত পাজামা, ফ্রক, জরীর ওয়েস্ট কোট, ওড়না পরিধান করেন। বিভিন্ন অলংকার তারা পরিধান করেন। ভরত নাট্যম নৃত্যে শিল্পীরা দক্ষিণী ভারতীয় পদ্ধতিতে শাড়ি, সামনে কোঁচা, কোমরে বেল্ট, চোলি, ওড়না, মাথাতে বিনুনী করে ফুলের মালা, খোপাতে রকরী, সিঁথির দুইদিকে চন্দ্র ও সূর্যের মত সাদা পাথর বসান গয়না, কোমরে মেখলা ইত্যাদি পরিধান করেন। এছাড়া নেকলেস প্রভৃতি বিভিন্ন অলংকার তাঁরা পরিধান করেন। সুতরাং প্রত্যেকটি নৃত্যের ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক বেশ ভূষা ও রূপ সজ্জা প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এই বেশভূষা ও রূপসজ্জাগুলো সঠিকভাবে নির্দিষ্ট চরিত্র অনুযায়ীকরা উচিত। কারণ বেশভূষা ও রূপ সজ্জার দ্বারাই আমরা কোনটি কোন নৃত্য বাকে কি চরিত্রে অভিনয় করছেন তা বুঝতে পারি। সুতরাং একজন নৃত্যশিল্পীর সুন্দর ও যথাযথবেশ ভূষা ও রূপসজ্জা করা উচিত। যথাযথ সুন্দর বেশভূষা ও রূপসজ্জার দ্বারাই দর্শকচিত্ত আকৃষ্ট হয় এবং এর দ্বারা নৃত্য শিল্পী কি নৃত্য করছেন দর্শকবৃন্দ তাও বুঝতে পারেন।
বেশভূষার সাথে সাথে রূপসজ্জার দিকেও শিল্পীর খেয়াল রাখতে হবে। রূপসজ্জা বা মেক-আপ এমনভাবে পরিমিত ব্যবহার করতে হবে যেন তাতে তার মার্জিত রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। মেক-আপকরাও একটা আর্ট। নৃত্যশিল্পীদের এ বিষয়েও প্রশিক্ষণ নেয়া প্রয়োজন। য়