সোমবার, নভেম্বর ১৭, ২০২৫
৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

আপনি পড়ছেন : নিয়মিত কলাম

সংগীত বিষয়ক গল্প : শাপের কোঙর

সংগীত বিষয়ক গল্প : শাপের কোঙর


রফিকুজ্জামান রণি
2025-05-31
সংগীত বিষয়ক গল্প : শাপের কোঙর

সংগীত বিষয়ক গল্প
শাপের কোঙর
-রফিকুজ্জামান রণি

নির্বিকার দুপুরটা মধ্যরাতের মতোই ক্লান্ত। 
অভিশপ্ত বাড়িটার সামনে এসে যখন দাঁড়াই তখন সূর্যটা উপুড় হয়ে ঢালছে রৌদ্রের গরল। লোহাগড় এলাকা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত ইতোমধ্যে পকেটস্থ করে রেখেছি। পত্রিকার অংশ বিশেষও সঙ্গে এনেছি। ফলে, পথ চিনতে সমস্যা হয়নি। আমরা চারজন। এখানেও ছবি তোলার মুদ্রাদোষ ছাড়তে পারেনি রুহুল। তুলবে না? শহরের চৌহদ্দি পেরিয়ে গ্রামের আলপথে হেঁটে বিশুদ্ধ বাতাস লুফে নেয়ার সুযোগ যে কতদিন পর এলো! 
দুর্গম এলাকা। বাড়িটার চারপাশে সুউচ্চ দেয়ালের বেষ্টনী। ভেতরের অতীত রহস্য অনেকেরই অজানা। আপাতদৃষ্টিতে সুন্দর দেখালেও, ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাড়িটি ছিল এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে ত্রাসের প্রতীক। নিদ্বির্ধায় এখানে পা রাখার দুঃসাহস তৎকালে কেউ দেখাতে পারেনি। সেই জমিদারপুত্র শৈত্যনাথ ও দৈত্যনাথের ইস্পাত কঠিন ক্ষমতার দাপট যে আজ কোথায় গেলো!
বাইরে থেকে ভালো করে তাকালে উপলব্ধি করা যায় জমিদার জৈন্তনাথের বিলাসবহুল জীবনব্যবস্থার কথা। এতো নিরাপত্তার বলয় ডিঙিয়ে ভেতরে ঢোকা ভার। ফটকের পর ফটক। জনশ্রুতি আছে, জমিদার জৈন্তনাথের শাসনামলে এ বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটার সময় সাধারণ মানুষকে জুতা জোড়া বগলদাবা করে রাখতে হতো। নীচু-জাতের মানুষদের খালি পায়ে হেঁটে যেতে হতো এ পথ দিয়ে। 
এ রকম কথাও প্রচলন আছে যে, এক রাতে কালসাপের দংশনে পুরো জমিদার বংশটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়; এরপর আর বাড়ির ভেতরে প্রবেশের স্পর্ধা দেখায়নি কেউ। কেউবা এলে বাড়ির ভেতরে বিচরণরত সাপের হিসহিস শব্দ-খুঁনসুটি বাইরে থেকে শুনতে পায়, বিশেষ বিশেষ রাত্রিতে জমিদারমহল থেকে তরুণী-পায়ের নুপূর-নিক্কণ কিংবা ঘুঙুরের শব্দপ্রবাহ এখনও বাইরের দিকে ভেসে আসে! ফলে, ভেতরে ঢোকার সাহস পায় না কেউ। কালেভদ্রে যদি কেউ ঢুকেই পড়ে আর ফেরৎ আসে না। সাপখোপের ভয়ে যুগের পর যুগ এখানে জন-চলাচল বন্ধ। সবই লোকমুখে শোনা, কথিত-বচন। সত্য-মিথ্যে সম্পর্কে আমরা না-ওয়াকিফ। বর্তমানে অবস্থার উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। অদূরেই নির্মিত হচ্ছে সারি সারি স্থাপনা, গড়ে উঠছে বাণিজ্যিক কেন্দ্র। জনজীবনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। 
শত বছরের পুরনো পাঁচিলের অনেকাংশ ধসে পড়েছে, ভেতরের অনেক কিছু বাইরে থেকেই দেখা যায়। ঝোঁপ-জঙ্গলে ঠাসা। ডানপাশে বজরী খালের বুকে স্বচ্ছ পানির ধারা। খালটি জমিদার বাড়ির অঙ্গশোভা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, বোঝা যায় বড় রূচিবান মানুষ ছিলো তারা। আরেক পাশে বিশাল দিঘি। শোনা যায়, এ দিঘিতে জমিদার তার আপন মাকে ডুবিয়ে হত্যা করেছে। অসুস্থ মা একদিন আম-দুধ খেতে চেয়েছিল। পুরো দিঘির জল সেচে সেখানে দুধ দিয়ে ভরাট করা হলো। দেয়া হলো মণকে মণ আম, তারপর, ‘খা মা, তুই প্রাণভরে আম-দুধ খা’Ñএই কথা বলে তাকে ছুড়ে ফেলে দেয় দিঘিতে। সেখানেই তার দুধেল-সমাপ্তি ঘটে। 
মানুষের কৌতূহল তেল-ঢালা আগুনের মতো উসকে ওঠে বারবার। পত্রিকায় পড়ে এতো বেশি কৌতূহল দশায় পড়েছি যে, বাড়ির ভেতরে ঢোকার লোভ সামলাতে পারলাম না। ডর ভয় উপেক্ষা করে প্রথমে একবার ভেতরের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে দর্শনার্থীদের জোর আপত্তির চাপে ফিরে এসেছি। সুযোগ পেয়ে সবাই উপদেশ বিলাচ্ছেÑ ‘ওখানে জীবন-নাশের আশঙ্কা অনিবার্য। ওই ভবনে ঢোকার কথা চিন্তা করতে গেলে পাগলেও সাত গেলাশ পানি খায়।’ 
বাইরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করা, প্রবীণ ও অভিজ্ঞজনের কাছে তথ্য সংগ্রহের মধ্য দিয়ে অনেক সময় ব্যয় হয়ে গেলো।
সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। রোদের তাল বিলুপ্তির পথে। কমেছে মানুষের শোরগোল। মোটাসোটা গাছটার শীর্ণকায় ডাল চেপে দুটি মিথুনরত কবুতরের রঙ্গলীলা আমাদের সাময়িক মনোযোগ কেড়ে নিলো। ক্লিক ক্লিক ছবিও তুলল রুহুল। বাতাসের ঝাপটা শরীরের কাপড় নিয়ে টানাটানি শুরু করলো। শীতল বাতাসের পরশে সারাদিনের ক্লান্তি-শ্রান্তি ক্রমশ হালকা হয়ে গেলো।
হঠাৎ ভেতর থেকে নবজাতক শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো! 
সদ্যজাত শিশুর ‘ওঁয়া ওঁয়া’ শব্দ-আর্তি কৌতূহলের মাত্রা বাড়িয়ে দিলো। অন্ধকূপের ভয় উপেক্ষা করে ভেতরে ঢোকার সিদ্ধান্ত নিই এবং বুকে থুথু দিয়ে ভেতরের দিকে পা বাড়াই। পেছনে ভীতু মানুষের হায় হায় চিৎকার তোয়াক্কা করার চিন্তা এ যাত্রায় ইস্তফা দিলাম। 
ভৌতিক অন্ধকারাচ্ছন্ন বাড়ির ভেতরটা বিভিন্ন গাছ গাছালিতে ঠাসা। ক্ষুদে জঙ্গল বললেও অত্যুক্তি হবে না। নান্দনিক ইমারতের আদ্যোপান্ত জুড়ে নানা রকম পরগাছা ও অপ্রয়োজনীয় শ্যাওলার আধিক্য। পাঁচিল লাগোয়া ইতিউতি পত্রাচ্ছন্ন কয়েকটি আকরকাঁটা গাছ, পাশে একটা নাগলিঙ্গম গাছের ফুল ফণা তুলে তাকিয়ে আছে সোনালু গাছটার দিকে। আমাদের চলনভঙ্গি দেখে একটি ত্রিশঙ্কু দোয়েল ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল ইশান কোণে। নির্ঘাৎ বিপত্তি জেনেও এস্তপায়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।  
প্রাসাদটি দুটি ভাগে বিভক্তÑ এক. অন্দরমহল। দুই. আমোদ ভবন। আমোদন ভবনে থাকতো জমিদারের দুই পুত্র শৈত্যনাথ ও দৈত্যনাথ। যতো রকমের অনৈতিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতো সবকটির নীরব সাক্ষী এই আমোদ ভবন। বাম দিক থেকে বিচ্ছিরি একটা গন্ধ তেড়ে এসে নাকের ডগায় পড়লো। পকেটে গ্যাস লাইট, হাতে সম্বলিত মোবাইল সেট থাকায় ভয়ের মাত্রা কমে আসলো। সুনসান নীরবতার ব্যূহ ভেঙ্গে আমরা সামনে এগোচ্ছি। পা টিপে টিপে অত্যন্ত সন্তর্পণে। 
চারপাশে কয়েক জোড়া চোখের সতর্ক চাহনি। ভেতরে উচ্ছন্ন পরিবেশ, কোথাও কোথাও কীটোৎসবের শঙ্খধ্বনি। এখনও মানুষের অস্থিপণ্ডুরের ফসিল যেন পড়ে আছে। ঊর্ণাজালে জেলামের মতো ঝুলছে বেকার মাকড়সা। শিশির-পেলব নৈঃশব্দতা ভেদ করে সামনের দিকে এগোলাম। পেছনে অসীম নীরবতা। চকিত বজ্রপাতের মতো বিকট একটা শব্দ আমাদের পথচলা স্থবির করে দিলো!  
অবাক কাণ্ড! আমোদ ভবনের উত্তর-পূর্ব কোণে অর্ধভাঙ্গা কপাটের জীর্ণ শরীর বেয়ে সুবিশাল ফণা উচিয়ে কোত্থেকে যেন বেরিয়ে এলো ভয়ঙ্কর এক কালকেউটে। ভয়ে মূঢ় হয়ে গেলাম সবাই। বিরতিহীন তপ্তশ্বাস সর্বাঙ্গ অবশ করে দিলো। এক ভয়াল আড়ষ্টতা চেপে ধরলো আমাদের। এমন অদ্ভূত সাপ পৃথিবীর কোথাও দেখিনি। ভয় ঢুকে গেলো, চিরতরে ভ্রমণের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এখানেই সম্পন্ন হয়ে যাবে আজ। পেছনে হটার চেষ্টা করতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম। অদৃশ্য শেকড় আমাদের পা’গুলো মাটির সঙ্গে সেঁধিয়ে দিলো। চলৎশক্তিহীন চারজন বিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইলাম। 
রাহুগ্রস্ত পরিবেশে স্বল্পসময়ের মধ্যে এক অলীক বিস্ময়ের উপসর্গ যোগ হলো। ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছেড়ে সাপটা হাই তুলতে শুরু করলো। অজানা কারণে আবার শরীর গুটিয়ে নিলো। বার কয়েক কালো জিভ নাড়া-চাড়া করলো। আবার সজোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো। ততক্ষণে তার কালচে লিক লিকে জিভ বেয়ে মাটিতে পড়লো বীর্যের মতো এক দলা শ্বেতশুভ্র লালা। শরীরে কাঁটা দেয়ার মতো ভয়ঙ্কর পরিবেশের মুখোমুখি হলাম আমরা! কিন্তু আমাদের দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে ধীরে ধীরে সাপটা অন্দরমহলের দিকে হারিয়ে গেলো!  
ঘোরের মধ্যেই দেখতে পেলাম সাপের ফেলে যাওয়া লালা থেকে জন্ম নিয়েছে ফুটফুটে এক শিশু! ভয়ে আমাদের রোমকূপ খাড়া হয়ে গেলো। উপায়ান্তর না পেয়ে দোয়া-দরূদ পড়তে শুরু করলাম। তথাপি অদৃশ্য হাত এসে আমাদের টুঁটি চেপে ধরলো! কোনো কিছুই উচ্চারণ করতে পারছি না, মনেও আনতে পারছি না কিছু। কে জানে, হয়তো এ ভ্রমণই আমাদের পরভূমে-ভ্রমণের জন্যে যথেষ্ট।
কোন প্রকার চিৎকার চেঁচামেচি ছাড়াই পায়ে ভর দিয়ে বাচ্চাটা দাঁড়িয়ে পড়লো। ঝড়ে-পাওয়া বাঁশপাতার মতো আমাদের শরীর থরথর করে কাঁপছে। বিস্ময়ের রেশ না কাটতেই সে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রশ্ন করলোÑ ‘তোমরা কারা? কেন এসেছো এই মৃত্যুপুরীতে?’ 
পৃথিবীর কততম আশ্চার্য ঘটনা, এটা আমরা বলতে পারবো না, নবজাতকের মুখে এত সুন্দর উচ্চারণ! দাঁড়িয়ে থাকার চোখ ধাঁধানো ক্ষমতা! এ কোন প্রহেলিকা! আমরা খোয়াব দেখছি নাতো! 
না, সত্যি। সবই সত্যি। নিরেট কিংবা আপ্তসত্যি!
সফর সঙ্গী ইয়াকুব বেজায় সাহসী মানুষ, সবাই তার সাহসের তারিফ করে। ইয়াকুব নিজেও এ দৃশ্য দেখে বাকশূন্য হয়ে পড়েছে। আমার তো খেই হারানোর অবস্থা! সবার পেছনে ছিলো হাবিব। সাহস নিয়ে উত্তর দিলোÑ ‘আমরা সমাজকর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবী। এ বাড়ি সম্পর্কে ইতিহাস ঘেঁটে অনেক আকর্ষণীয় তথ্য পেয়েছি, তাই বাস্তব ধারণা নিতে এসেছি।’
উদ্ভট একটা শব্দ তুলে বাচ্চাটা হাসলো। হাসির শব্দটা জমিদার বাড়ির ত্রিসীমানা ছাপিয়ে বিস্তীর্ণ ফসলীভূমির উপর দিয়ে চক্কর মেরে কতদূর এগিয়ে গেছে আমরা জানি না। কিন্তু দেয়ালের সাথে আঘাত খেয়ে শব্দটার যে পুনরাবৃত্তি ঘটছে তা ঠিকই টের পেয়েছি। 
গম্ভীর একটা ভাব নিয়ে সে জানতে চাইলোÑ‘প্রাচীন ইতিহাস জেনে কী করবে? মায়ের সন্তান মায়ের কোলে ফিরে যাও। নচেৎ সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছে।’
তবে তার চেহারায় রুষ্টতা নেই, তাই সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করলাম। কথার খাতিরে সাহস জন্মেছে ঢের। নিভর্য়ে দু’কদম সামনে এগোলাম। প্রশ্ন করলাম, ‘ঠিক আছে আমরা চলে যাচ্ছি। কিন্তুু তোমার সর্ম্পকে যদি ধারণা পেতাম তবে আমাদের ভ্রমণটা সার্থক হতো। দয়া করে বলবে কি তুমি কে? এত সুন্দর ভাষায় কথা বলছ কীভাবে? সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছো কোন আচানক শক্তিতে?’
‘আমি জমিদারপুত্র শৈত্যনাথ ও দৈত্যনাথের অভিশপ্ত সন্তান। বলতে পারো শাপের কোঙর!’ বিলম্ব না করে জবাব দিলো। এই ফুরসতে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা টিকটিকি টুক টুক শব্দে বার কয়েক গলা খাঁক দিলো। অপ্রস্তুত হয়ে রুহুল প্রশ্ন করে বসলোÑ
‘বনসাই জীবন! এটা কীভাবে সম্ভব! এত বছর পরও তুমি শিশু রয়ে গেলে, কে তোমাকে লালন পালন করছে?’ 
কালক্ষেপণ করলো না। মৃদু হাসির রেখা ভেসে ওঠলো মুখে।
‘কেন সম্ভব নয়? জমিদারদের বিশাল প্রতিপত্তি যদি এক লহমায় ধূলিস্মাৎ হয়ে যেতে পারেÑএটা সম্ভব হবে না কেন? ওই গোখরাই আমার দেখভাল করে। তার পেটের ভেতরেই আমি বেঁচে থাকি।’
নব্বই শতাংশ ভয়ের মেঘ কেটে গেল। রহস্যের কোনো কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। স্থির করতে পাচ্ছি না পৃথিবীটা আজ কোন প্রান্তে এসে ঠেকেছে! আমরা কী এখনও পৃথিবীতে আছি নাকি অন্য কোনো মুল্লুকে ছিটকে পড়েছি? অন্তহীন আগ্রহ নিয়ে, অনেকটা কথাচ্ছলেই জিগ্যেস করলামÑ‘বেয়াদবি না নিয়ে একটু খুলে বলবে কি স্বঘোষিত একজন ‘অভিশপ্ত সন্তান’ দাবি করার প্রকৃত রহস্য? কিভাবে তোমার আর্বিভাব ঘটেছে? একজন মানুষ দুই পিতার সন্তান হয় কীভাবে?’
প্রাসাদের দক্ষিণ প্রান্তের ছাদস্পর্শী পরঘরি গাছের ঝোপে কী যেন একটা পায়চারী করতে দেখলাম। হয়তো বিষাক্ত কোনো প্রাণি-টানিই হবে। এখানে সাধারণ প্রাণিদের চলাচল না থাকাটাই স্বাভাবিক। এতদূর থেকে পরিষ্কার দেখা না যাওয়ায় ঠাওরাতে পারছি না ওখানটায় কিসের এত হট্টগোল। যদিও অল্পসময়ের জন্যে আমার চোখজোড়া ওখানে স্থির কিন্তু মনোসংযোগ অলৌকিক শিশুটির দিকেই। অদ্ভুত সেই দৃশ্যটার দিকে তার কোনো নজর পড়লো কিনা সেটাও অনুমান করতে পারলাম না। 
প্রথমে নির্ভার ও অনুসন্ধিৎসু চোখযুগল সে আমাদের দিকে তাক করলো। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর নাতিদীর্ঘ জবাব ছুড়লোÑ ‘তোমরা যেহেতু সমাজকর্মী, তাই বলছি। জানি, এই কথা পৃথিবীর মানুষের কাছে পাচার করবে তোমরা। ঘৃণ্য ইতিহাস লেখা হতে পারে খবরের কাগজেও। মানবজাতি যেন শিক্ষা নিতে পারে তাই বলতে কার্পণ্য বোধ করছি না। আমি এমনই একটি সময়ের প্রতীক্ষায় ছিলাম। তবে সাবধান! এরপর যেন এই প্রাসাদের ভেতরে কেউ প্রবেশ না করে। করলে তার বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে, এ সতর্কবাণী সবাইকে জানিয়ে দিও।’
মাথা নেড়ে আমরা আশ্বস্ত করলাম। ইতিবাচক সায় দেয়ায় বলতে শুরু করলো সে: 
‘এই লোহাগড় এলাকার জমিদার, মানে আমার পূর্বপরুষেরা ছিল অত্যাচারী শাসক। তাদের হিংস্র আচরণ থেকে ছোট-বড়, মেয়ে-ছেলে কেউ রেহাই পেতো না। আজকের এই জীর্ণশীর্ণ বাড়িটি এক সময় গান-বাজনায় মুখরিত ছিল। রাতের নিস্তব্ধতায় নূপুরের নিক্কণ ধ্বনি পুরো এলাকাটিকে আবিষ্ট করে রাখত। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশিষ্ট শিল্পীদের নিয়ে নিয়মিত আসর বসত। এ বাড়ীতে মজমা করে গেছেন উপমহাদেশের বিখ্যাত বাঈজী মীরা বাঈ, সুলোচনা বাঈ, শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী দেবনিষ্ঠা জানা। যার সুরে গাছের পাতারাও নেচে উঠতো। ওই সময়কার এমন কোন নামকরা শিল্পী নেই যাদের পদধুনী এই বাড়ীতে না পড়েছে। আনন্দ-উৎসবে গান গাইতেন শৈত্যনাথ ও দৈত্যনাথ।  তাদের গানের প্রতি আসক্তি ছিল পাগলামির পর্যায়ে। যদি কোনো শিল্পীর গান অপছন্দ হতো কিংবা কেউ সুরে সামান্য ভুল করত, তবে তাদের আটকে রেখে শাস্তি দিতেন দুই ভাই। স্বার্থ চরিতার্থ ও ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে যে কোন ক্রিয়াকলাপে জড়িয়ে পড়তে ইতস্তত বোধ করত না তারা। খাজনার টাকার জন্যে অধীন গরীবের চাষাভূষাদের হত্যা করতেও হৃদয় কাঁপতো না তাদের। আমার দাদা জমিদার জৈন্তনাথের প্রশ্রয়ে তার দুই পুত্র শৈত্যনাথ ও দৈত্যনাথ নিজেদের খেয়ালখুশি মতো অপকর্ম করে বেড়াতো। তাদের খামখেয়ালিপনার কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। যদিও জমিদারি ছিলো জৈন্তনাথের কিন্তু ক্ষমতার কলকাঠি নাড়তো তারই আদরের দুই পুত্র শৈত্যনাথ ও দৈত্যনাথ। তাদের যে কোনো বেহায়াপনায় তিনি ছিলেন নিরব দর্শক। 
কেউ যদি কথার অবাধ্য হয়েছে তবে তার ওপর নেমে আসত অমানবিক নির্যাতন। উচ্ছেদ করা হত শির! পথে কোনো সুন্দরী নারী চোখে পড়লে তুলে এনে দুই ভাই পালাক্রমে ভোগ করতো, নিজেদের পাপ বাসনা পূরণ করতো। সম্ভোগের পর মেয়েটিকে হত্যা করে গুহায় নিক্ষেপ করতো। কোনো কৃষক-বেরুনিয়া খাজনা প্রদানে ব্যর্থ হলে তার সুন্দরী স্ত্রী-কন্যাকে তুলে এনে নিজেদের ভোগের বস্তুতে পরিণত করতো।  
শৈত্যনাথ ও দৈত্যনাথ প্রতিদিন বিকেলে ঘোড়ার গাড়িযোগে বাইরে বেরুতো। সঙ্গে থাকত হিংস্র প্রহরী। পথিমধ্যে কোনো গর্ভবতী মহিলার দেখা পেলে দুই ভাই খেলাচ্ছলে মহিলার আসন্ন বাচ্চা সম্পর্কে কুট-মন্তব্য করতো এবং হাসি-তামাশা করতো। একজন বলতোÑ‘এই মহিলার পেটে পুত্র সন্তান আছে।’ অন্যজন বলতোÑ‘না। না। তার পেটে আছে কন্যা সন্তান।’ এনিয়ে দুজনের মধ্যে চলতো তুমুল তর্ক। অন্যথা না পেয়ে, যাচাইয়ের জন্যে দুজন বাজি ধরতো। বাজিতে জেতার জন্যে প্রহরী দ্বারা মেয়েটিকে তুলে এনে প্রকাশ্যে পেট কেটে পরীক্ষা করা হতোÑসেখানে কন্যা সন্তান, না পুত্র সন্তান। যে ভাই বাজিতে বিজয়ী হতো তাকে উপহারস্বরূপ দেয়া হতো নতুন কোনো সুন্দরী রমণীকে। পরবর্তীতে পথ চলতে গিয়ে যে সুন্দরী রমণীটি চোখের সামনে পড়তো তাকেই বিজয়ীর সম্ভোগের উপঢৌকন হিসেবে তুলে আনা হতো।  
শেখহাটি গ্রামের নৃশংস এক ঘটনার প্রতিবাদের ঢাল হিসেবে আমার আর্বিভাব ঘটে। লোহাগড় এলাকার জমিদারের অধীনস্থ এক গরিব চাষার সোমত্ত কন্যা বিশ্বজিৎ দাশ নামের এক রাখালের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। মেয়েটির নাম ছিল কমলা। রাঙা হালতির মতো রূপ-লাবণ্যের জাদুতে পুরো এলাকা মুখরিত করে রাখতো সে। ওই যে মৃত অজগরের মতো বয়ে গেছে বজরীখাল। তার পাড়ঘেঁষে বেড়ে ওঠা কাশবনের আড়ালে তাদের ভালোবাসার ছাপরেখা এখনও লেগে আছে। সামনেই খোলার মতো একটা খালি জায়গায় ছিলো ছায়াশীতল বটগাছ। বজরীখালের মৃদু ঢেউয়ের কল্লোলের সাথে তাল মিলিয়ে তার নীচে বসে আপন মনে বাঁশি বাজাতো রাখাল, গান গাইতো। রোজ বিকেলে কমলা ছুটে আসতো তার কাছে। মনের সুতোয় বাঁধা পড়ে যায় দুজন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিতো একসঙ্গে। একসময় ফাঁস হয়ে যায় তাদের খবর। দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ের দিনও ধার্য হয়। ভালো দিনক্ষণ দেখে বিয়ের দিনও ঠিক হয়। কপোত-কপোতির বুকে খুশির ঢেউ উছলে উঠতে শুরু করে। মাহেন্দ্রক্ষণের প্রতীক্ষায় যেন ফুরায় না তাদের বেলা।    
সেবার ভয়াবহ বন্যায় মাঠের সব ফসল নষ্ট হয়ে যায়। চলার পুঁজিটুকু হারিয়ে ফেলে গরিব চাষা। একদিকে দুর্বিষহ অবস্থা। অন্যদিকে জমিদারের লোকজন খাজনা আদায়ে আঁটঘাট বেঁধে নেমেছে। ঘন ঘন তাগাদা দিচ্ছে। খাজনা পরিশোধ না করতে পারলে শুরু হয় মারপিট ও হরিলুট। তাদের খপ্পর থেকে নারী-পুরুষ কেউ রেহাই পায়নি। কমলার বাবা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় মেয়ের বিয়ে নিয়ে। তারপরও ভাবে, মেয়ের বিয়ের কথা শুনলে জমিদারের লোকজন হয়তো একটু দয়া-দাক্ষিণ্য দেখাবে। বিলম্বে খাজনা পরিশোধের সুযোগ হয়তো দেবে। সময় ভালো থাকতেই মেয়েটিকে পাত্রস্থ করা দরকার। 
বিশ্বজিৎ ও কমলার বিয়ের দিন চলে এলো। চারদিকে সাজসাজ রব। পাড়ায় মানুষের ঢল নেমেছে। গান, বাজনা ও হাসি তামাশায় টইটম্বুর পুরো বাড়ি। সালংকরা বধূকে ঘিরে উৎসুক্য জনতার ভিড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বরযাত্রী চলে আসবে। হৈ-হুল্লোড়ে মুখরিত পুরো বাড়ি! দরিদ্র চাষার জীর্ণকুটির যেন সোনার নহরে পরিণত হয়েছে। ঠিক সে-মুহূর্তে ধপাস্ ধপাস্ ঘোড়ার খুড়ের শব্দ-পরম্পরা এগিয়ে এলো, বিয়ে বাড়ির পূর্ব গেট পেরিয়ে আঙিনায় এসে থামলো। শুরু হলো মানবরূপী পশুর তর্জন-গর্জন। ‘এ বিয়ে বন্ধ কর’Ñ হুঙ্কার ছাড়লো। তারপর খাজনার টাকা পরিশোধ না করার দায়ে কমলার বাবা শম্ভু দাশকে মারতে আরম্ভ করলো। সাথে অশ্রাব্য গালি। কয়েকটি দানব-হাত কমলাকে বিয়ের আসর থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেলো জমিদার মহলে। 
বিশজিৎ জানতে পারলো জমিদারের দোসররা কমলাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে নিয়ে গেছে; ক্ষুব্ধ হয়ে নাঙ্গা তালোয়ার হাতে ছুটে গেলো কমলাকে মুক্ত করতে। ক্ষমতাধরের সীমাহীন দাপটের কাছে বিশ্বজিতের মতো রাখাল ধোপের বাড়িতেই হারিয়ে গেলো। জমিদারের বিশাল সৈন্যবহরের কাছে সে ক্ষুদ্র একটিপ্রাণি ছাড়া কিছুই না। প্রথম ফটকেই তাকে শিরচ্ছেদ করা হলো। সমাহিত হলো একটি জীবন্ত প্রেমের গল্প। ’ 
এমন লোমহর্ষক কাহিনি শুনে হতভম্ভ হয়ে গেলাম আমরা। চোখের পানি রোখা দায়। ভেতরে অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে। আমরা ভয় পাচ্ছি না। বাইরের লোকসংখ্যা বোধ হয় এতক্ষণে শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। জমিদার মহলে সুপ্ত থাকা এক মর্মন্তুদ কাহিনি তারা কী করে জানবে? যারা আমাদের ভেতরে ঢুকতে নিষেধ করেছে তারা হয়ত এতক্ষণে নিশ্চিত হয়েছেÑআমরা বেঁচে নেই। আবেগাপ্লুত হয়ে ইয়াকুবের মুখে প্রশ্ন মুদ্রিত হলোÑ‘তুমি এত কাহিনি জানলে কীভাবে?’
বাচ্চাটা একটু বিরক্ত হলো। বললোÑ ‘পুরো কাহিনি শেষ না করতেই প্রশ্ন করা অন্যায়। প্রশ্ন থাকলে পরেও করা যায়। কথার ফাঁকে কথা বলে ত্যক্ত করার যুক্তি কী?’ 
বিব্রত হয়ে হাসলাম, Ñ‘স্যরি! রাগ করো না। তুমি বলো।’
‘পরের কাহিনি আরো করুণ, বর্বরোচিত। কমলাকে প্রাসাদে রেখে শৈত্যনাথ ও দৈত্যনাথ পালাক্রমে ভোগ করতে লাগলো। মেয়েটির কোনো অধিকার ছিল না এ বাড়িতে। জমিদারপুত্রদের মনোরঞ্জন করাই ছিলো তার একমাত্র অধিকার। পায়ে নূপুর কিংবা ঘুঙুর বেঁধে প্রতিরাতে তাকে নর্তকী সেজে নাচতে হতো। দানবের মতো দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে তার নাচের প্রশংসা করত তারা। জমিদার জৈন্তনাথ কোনো প্রতিবিধান না করে নীরবে সমর্থন করে গেলো। অভিশপ্ত জীবন থেকে বাঁচতে কমলা আত্মহুতির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। তজ্জন্যে তাকে শারীরিক নির্যাতনও পোহাতে হয়েছে। দরিদ্র পিতামাতাকে হত্যার হুমকি দিয়ে তাকে ভোগের বস্তু বানিয়ে রেখেছে এবং আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। জগদ্দল পাথরের নিচে চাপা পড়ে থেঁতলে গেলো তার জীবনের সাধ-আহ্লাদের সাজানো ডেরা। বিয়ের স্বপ্ন মাটিতে পুঁতে রেখে কমলা পরিণত হলো গণিকায়। কিন্তু এ জীবন তো দ্রৌপদীর মতো আনন্দমিশ্রিত নয়।   
শৈত্যনাথ ও দৈত্যনাথের শারীরিক মেলামেশার কারণে কমলা গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এ খবর ছড়িয়ে যায় সবখানে। শৈত্যনাথ ও দৈত্যনাথ সংবাদ পেয়ে খুশিতে টগবগিয়ে উঠলো। প্রথমবারের মতো বাবা হচ্ছে তারা! শৈত্য কিংবা দৈত্য যারই ঔরসজাত সন্তান হোক না কেনÑসে এই জমিদার বংশের আলো। তাই তাকে বরণ করে নেয়া এই জমিদার বংশের খানদানি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কমলার কাছে এই ফেলশানি-সন্তান কালকূটের মতো মনে হলো। পাপিষ্ঠ জীবন আর কত দিন বইবে সে? অনন্যোপায় হয়ে বেদনার্ত মনে প্রার্থনাগারে ঢুকে নিভৃতে অশ্রু ফেলে সে। তার বুকের তস্তুরিতে কেবল অভিশাপ সাজানো, আর কিছু নয়। 
পুরো অঞ্চলে ঢোল-তবলা বাজিয়ে জানিয়ে দেয়া হলো জমিদারপুত্র শৈত্যনাথ ও দৈত্যনাথের যৌথভ্রƒণে জন্মানো আসন্ন সন্তানের কথা।  মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এ-নিয়ে ঘটা করে পার্টির আয়োজন করা হবে জমিদার মহলে। জমিদার বংশের সবাইকে পার্টিতে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানানো হয়। জমিদারের তল্পিবাহক কর্মকর্তাদেরও নিমন্ত্রণ জানানো হয়। সংবাদ দেয়ার পর মিশ্র-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো। শুরু হয় কানাঘুষাÑ ‘এটা আবার কেমন কথা রে বাপু! দুই পিতার এক সন্তান! ছি! ছি! দুনিয়া কী মাছের পেটে!’ 
বানের পানির মতো উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে সকাল থেকে জমিদার মহলে মানুষের ঢল নেমেছে। দুই ভাইয়ের এক সন্তান! এমন বাঁজপড়া সংবাদ শুনে অনেকে কৌতূহলবশে ছুটে এসেছে। জমিদারের আজ্ঞাবহ কর্মকর্তারাও তসরিফ এনেছে। যাদের মধ্যে ন্যূনতম বিবেকবোধ ছিলো, ভিন্ন অযুহাতে অনুষ্ঠান প্রত্যাখান করেছে তারা। 
সাড়ম্বর আয়োজন। কমলাকে বেশ সুন্দরভাবে সাজানো হলো। এ বাড়িতে সে নেহায়েত যৌনদাসী। তারপরও তাকে সাজানো হয়েছে নববধূর মর্যাদায়। তার আগত সন্তানের মঙ্গল কামনায় তাকে আজ আর্শিবাদ করা হবে। কেন যে জমিদাররা হঠাৎ উদার ভাব দেখাচ্ছে তার গূঢ়ার্থ উ˜্ঘাটন করা মুশকিল। কমলার কাছে পৃথিবীটা বিশাল এক বিষের পেয়ালা ছাড়া আর কিছুই মনে হলো না। 
অনুষ্ঠান যথাসময় আরম্ভ হলো। স্বাগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের কারণ ও প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করা হলো। জমিদার বংশের লতাপাতা যে কতো বিশাল তা অনুষ্ঠান দেখেই আন্দাজ করা গেলো। অনুষ্ঠানমালার একেবারেই শেষপ্রান্তে এসে ঘটলো এক ইতিহাস-প্রোথিত ঘটনা! কমলাকে আর্শিবাদ করার পালা। ঠিক সে মুহূর্তে, শ্বশুর-বাড়ি থেকে ছুটে আসা জৈন্তনাথ জমিদারের একমাত্র কন্যা জয়ানাথ বলে উঠলোÑ‘আগত সন্তান কি মেয়ে হবে, না ছেলে?’ কয়েক মুহূর্তের জন্যে অনুষ্ঠানস্থলে নীরবতা নেমে আসে। নিস্তব্ধতা উড়িয়ে দিয়ে দৈত্যনাথ অহঙ্কারের হাসি হাসলো।Ñ‘এ সন্তানের প্রকৃত পিতা আমি। আমি জানি আমাদের আসন্ন মেহমান হবেÑপুত্র সন্তান।’ শৈত্য তার মুখের কথা ছিনিয়ে নিলো। মুখ ভেংচিয়ে বলে উঠলোÑ‘আরে না, এটা হবে কন্যা সন্তান। আর আমিই তার প্রকৃত পিতা।’ 
পুরো বাড়িতে হুলস্থূল বেঁধে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে যেন কুরুক্ষেত্রে পরিণত হলো আমোদ-মহল। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরাও দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। কেউ ছেলে হওয়ার পক্ষে, কেউ বা মেয়ে হওয়ার পক্ষে। সেই সঙ্গে যুক্ত হলোÑ ‘পিতৃবিড়ম্বনা’। এ নিয়ে চলছে তুমুল তর্কাতর্কি। সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠলো। গোলমালের আভাস পেয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো জৈন্তনাথ জমিদার। কিন্তু সমস্যা সমাধান করতে পারলো না। 
সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হয়Ñ‘অন্তঃসত্ত্বা কমলার পেট কেটে দেখা হোক ওটা ছেলে সন্তান, না মেয়ে সন্তান। শৈত্যের কথা সঠিক হলে জৈন্তের মৃত্যুর পর এই এলাকার পরবর্তী জমিদার সে হবে। আর যদি দৈত্যের কথা সত্য হয় তবে এই বিধান তার জন্যেই প্রযোজ্য হবে।’ কমলা জানে মৃত্যু তার দোরগোড়ায়। অনেক দেরিতে হলেও সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারবে আজ। প্রনষ্ট জীবনের লরি ঠেলে ঠেলে আর কুলিয়ে উঠতে পারছে না। অভিশপ্ত সন্তানকে সে ঘৃণা করে। নিজের প্রজনন অঙ্গটিকে মনে হয় বিষফোঁড়া। মৃত্যুকে অতিথি ভেবে বরণ করতে তার কোনো আপত্তি নেই। দুর্দৈব জীবনের গল্প এখানেই সমাপ্তি হলে বড় মুক্তি পায়, তবুও যেন পৃথিবীর প্রতি এক অদ্ভুত মায়া! জমিদার মহলে উত্তেজনার শেষ নেই। কমলার পেট কাটা হবে! কমলার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। থাকলেও কোনো মূল্য থাকতো না। সবার উপস্থিতিতেই জল্লাদ ডাকা হলো। পেটও কাটা হলো। প্রকৃতির খেলা বোঝা বড় দায়! পেট কাটার সঙ্গে সঙ্গে পেট থেকে বেরিয়ে এলো বিরাট এক কালসাপ! লাল রক্তের পরিবর্তে বেরিয়ে এলো দুধশাদা পানির ফোয়ারা! শৈত্যনাথ ও দৈত্যনাথের সারাজীবনের কীর্তকলাপের ফসল হিসেবে জন্ম নিয়েছে এই অলৌকিক সাপ। এতো বড় সাপ কারো পেটে থাকতে পারেÑএই ঘটনা যে রূপকথাকেও হার মানায়! সাপ তার ফণা উচিয়ে যথারীতি নিজের দায়িত্ব পালন করলো। ওই রাতে জমিদার জৈন্তনাথের পুরো বংশ নির্বংশ হয়ে গেলো। ক্রদ্ধ গোখরার বিষাক্ত দংশন থেকে একজন মানুষও রক্ষা পেলো না। 
কমলা-হত্যার অনুষ্ঠানে যতো নির্দয় মানুষ উপস্থিত ছিলো তার সব কটিকে দংশন করার পর তার পেট থেকে নির্গত পানি দিয়ে সাপটা মুখ ধুয়ে নিলো। সেই ঘোলাটে পানি থেকেই জন্ম নিয়েছি আমি। আমার মা কমলার বীভৎস জীবনের সাক্ষী হিসেবে আজও আমি অই সাপের পেটে লুকিয়ে আছি। আজও এই সাপের তর্জনগর্জন মানুষ বাইরে থেকে শুনতে পায়।’  হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম আমরা!
এই আনকোরা জড়িমার খোয়াব ভাঙ্গতে না ভাঙ্গতেই লক্ষ্য করলাম অদূরেই হেলেঞ্চা ও শিকোরি গাছের মিত্রঝোপ। ওখানটায় অন্ধকারসমেত খোলতা আলোর লালচে একটা হাফটোন রেখা। বাচ্চাটি সামনে দাঁড়ানো। তার শরীর ভেদ করে পরিষ্কারভাবে দেখার জো নেই। ছোট্ট শরীর হলেও সে যেন বিশাল এক ছায়ামূর্তি! জানতে চাইলামÑ‘ওটা কী? এই অন্তঃপুরে আলো-আঁধারির দ্বৈতবিহারের গোপন রহস্যটা কী?
একটু বিচলিত হয়ে উত্তর দিলোÑ‘ওখানে মা ঘুমিয়ে আছেন। প্রতিরাতে এখানে ক্ষীণ আলোর মশাল নিয়ে অসংখ্য জোনাকির জন্ম হয়। কখনও কখনও তারা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। অসুরশক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তারা প্রতি অমাবস্যায় এখানে তোপধ্বনি তুলে। জোনাকিদের এই কোলাহল ধ্বনিকে মানুষ বাইরে থেকে নূপুরের কিংবা ঘুঙুরের শব্দ-ঝঙ্কার ভেবে বিভ্রান্ত হয়।’ কথাগুলো শেষ করতে না করতেই সে গলা উচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলোÑ‘বাঁচতে চাইলে এক্ষুনি পালাও। অন্যথায় নেমে আসবে সাঁড়াশি আক্রমণ!’
তোঁতলাতে তোঁতলাতে রুহুল তড়িঘড়ি করে বলছিলোÑ‘চলে যাচ্ছি। তবে তোমার একটা ছবি তোলার যদি অনুমতি দিতে তাহলে খুশি হতাম।’ ‘খবরদার! ও’ কথা আর মুখেও যেন না আসে। দ্রুত সটকে পড়ো।’ ভারাক্রান্ত মনে ফিরতি-পথে পা বাড়ালাম এবং প্রকট একটা শব্দে ঘাড় বাঁকালামÑএ যে এলাহি কাণ্ড! আড়াল থেকে সাপটা তরতরিয়ে বেরিয়ে এলো। এসেই বাচ্চাটিকে মুখে পুরে নিলো। তারপর নিরুদ্যম পায়ে ভেতরের দিকে ছুটলো। চলতি-পথে সাপের হিমেল স্পর্শে মধুমঞ্জরি লতাটা কেমন কম্পমান দেহে দুলে উঠল। যেন বহুদূর থেকে কানের মধ্যে একটা নজরুলগীতি ভেসে আসলো ‘আমার যাবার সময় হলো, দাও বিদায়...’ ঘোরগ্রস্ত পৃথিবী ভেদ করে উষ্ণ একটা বাতাসের ঝাপটা এসে ছিটকে পড়লো আমাদের গায়ে। স্বাভাবিক হলাম। কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক, এই করাল বাতাস ও পশ্চিমে তলিয়ে যাওয়া সূর্যটা ঠিকই জানেÑএটা কোনো রূপকথা কিংবা কল্পকাহিনী নয়। য়    
মুঠোফোন : ০১৮২৮৫৫৯০৯৩, ০১৭১২৭৪৯০৪৯

01_1748678671.jpg
01_1748678671.jpg