সোমবার, আগস্ট ১৮, ২০২৫
৩ ভাদ্র ১৪৩২

আপনি পড়ছেন : প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

জীবন সায়াহ্নে সুষমা দাস

জীবন সায়াহ্নে সুষমা দাস


মিহিরকান্তি চৌধুরী
2025-03-24
জীবন সায়াহ্নে  সুষমা দাস

বাংলা লোকগানের জীবন্ত কিংবদন্তি শিল্পী সুষমা দাস সাত দশক ধরে সংগীতের সাথে জড়িত। তার সংগ্রহে আছে অসংখ্য প্রাচীন লোককবির গান, অবাক ব্যাপার যে, গানগুলো কোনো ডায়রির পাতায় লিপিবদ্ধ নয়, সবই তার স্মরণশক্তির আওতায় পুঞ্জিভূত। বয়সের ভারে বেশ নুইয়ে গেলেও গাইবার সময় তার কণ্ঠ আগের মতোই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ৯৫ বছর বয়সী প্রবীণ এই শিল্পীর সুরেলা কণ্ঠে অবাক হন ভক্ত ও গানপ্রেমী শ্রোতারা। গাওয়ার সময় গানের খাতা দরকার হয় না। কেবল চোখ বন্ধ করলেই হয়। অনেকে প্রাচীন লোকগানের জীবন্ত দলিল বলেন তাকে। এক সাক্ষাৎকারে সুষমা দাস বলেন, ‘আমার জন্ম হাওরে। হাওর মানেই লোকগানের খনি। একে তো পরিবারের সবাই গান-বাজনার সঙ্গে জড়িত, এর মধ্যে গ্রামে কোনো উৎসব মানেই নানা ধরনের গান গাওয়া হতো। পাড়া-প্রতিবেশীরা ঘটা করে গানের আয়োজনে অংশ নিতেন। সেসব দেখে দেখে ছোটবেলা থেকেই আমার গান গাওয়া এবং শেখা। বাড়ির পাশ দিয়ে নৌকার মাঝি গান গেয়ে যেত, জ্যৈষ্ঠ মাসে সন্ন্যাস গান হতো, বর্ষা মৌসুমে বিয়ের ধুম পড়লেই হতো ধামাইল গানের আয়োজন। বৈশাখ থেকে চৈত্র মাস, বছরজুড়ে কতশত ধরনের গানের আয়োজন লেগে থাকত। উঠতে-বসতে গান। এই গানের মধ্যেই আমার বেড়ে উঠা। হাওরের মানুষ, গান তাই রক্তে মিশে আছে।’ দাদু-ঠাকুমা, দিদিমা, মা-বাবাসহ অনেকের কাছ থেকে লোকগান শিখেছেন সুষমা। কিছু গান আড়াইশ’ বছরের পুরোনো। কোনোটির গীতিকবির নামও অজানা। চণ্ডীদাস থেকে শুরু করে সৈয়দ শাহনূর, দীন ভবানন্দ, শিতালং শাহ, রাধারমণ, কালা শাহ, আজিম ফকির, অধর চান্দ, লুচন দাস, রূপমঞ্জুরি, শ্যাম সুন্দর, ব্রজনাথ, শ্রীরুক্ষিণী, রামজয় সরকার, হরিচরণ সরকার, দুর্গাপ্রসাদ, রসিকলাল দাস, মধুসূদন, কামাল উদ্দিন, শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ প্রমুখের গান করেন তিনি। সেসবের মধ্যে আছে কীর্তন, সূর্যব্রত, ধামাইল, গোষ্ঠ, সুবল মিলন, পালা, হোলিগান, পদ্মপুরাণ, বাউলা, সন্ন্যাস, বটকিরা ও কবিগান। ১৯৩০ সালের ১ মে (বাংলা ১৩৩৬) সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার শাল্লা থানার পুটকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সুষমা দাস। তার পিতা ছিলেন প্রখ্যাত লোককবি রসিকলাল দাস এবং মাতা সংগীত রচয়িতা দিব্যময়ী দাস। তার ছোটোভাই পণ্ডিত রামকানাই দাসও ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ও সংগীতসাধক। পারিবারিক আবহেই তিনি সংগীতের প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন। লোকগানের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকেই সুষমা দাশের সংগীতচর্চা শুরু হয়। লোকসংগীতের প্রতি তার নিবেদন এতটাই গভীর ছিল যে, তিনি হাজার হাজার গান মুখস্থ করে রাখেন, যা কোনো কাগজ-কলমে লিপিবদ্ধ না থাকলেও মনের ডায়েরিতে গেঁথে ছিল। বাংলাদেশের বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন সংগীত পরিবেশন করেছেন এবং দেশে-বিদেশে লোকগানের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। অবাক করা বিষয় হলো, প্রায় দুই হাজারের অধিক লোকগান মুখস্থ সুষমা দাশের। কোনো বই বা পান্ডুলিপির সাহায্য ছাড়াই তিনি এখনও শুদ্ধ বাণীতে গান পরিবেশন করে থাকেন। তিনি নিজেও কয়েকটি গান লিখেছেন তবে সেগুলো সংখ্যায় কম। ২০২০ সালে আজিমুল রাজা চৌধুরী তার সংগীত ও জীবনকথা নিয়ে “সুষমা দাস ও প্রাচীন লোকগীতি” শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এতে তার গাওয়া ২২৯টি প্রাচীন লোকগান সংকলিত হয়েছে। সুষমা দাস চার ছেলে ও দুই মেয়ের জননী। সুষমা দাশের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়াও তিনি পেয়েছেন : কলকাতা ‘বাউল ফকির উৎসব’ সম্মাননা (১৪১৭ বাংলা); জেলা শিল্পকলা একাডেমী গুণীজন সম্মাননা (২০১৫); রাধারমণ উৎসব সংবর্ধনা (২০১৭); রবীন্দ্র পদক (২০১৯)। বর্তমানে এই কিংবদন্তি শিল্পী বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন। তবুও সংগীতের প্রতি তার টান আজও অটুট। লোকসংগীতের এই মহান সাধকের সুস্থতা কামনায় সংগীতপ্রেমীদের দোয়া, আশীর্বাদ ও ভালোবাসাই তার প্রতি সর্বোৎকৃষ্ট সম্মান। সুষমা দাস শুধু একজন শিল্পী নন, তিনি বাংলা লোকসংগীতের এক জীবন্ত ইতিহাস। তার গানের সুর ও বাণী যুগ যুগ ধরে সংগীতপ্রেমীদের মনে স্থান করে নেবে। 

শিল্পী সুষমা দাস শুধু একজন কণ্ঠশিল্পী নন, তিনি বাংলা লোকসংগীতের এক জীবন্ত ইতিহাস। তাঁর গানের সুর ও বাণী যুগ যুগ ধরে সংগীতপ্রেমীদের মনে স্থান করে নিয়েছে, আগামীতেও  নেবে। বর্তমানে এই কিংবদন্তি শিল্পী বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন। ২১ মার্চ ২০২৫ তারিখ সন্ধ্যাবেলা সর্বশেষ খবর হলো, তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন। লোকসংগীতের এই মহান সাধকের সুস্থতা কামনায় সংগীতপ্রেমীদের দোয়া, আশীর্বাদ ও ভালোবাসাই হবে তাঁর প্রতি সর্বোৎকৃষ্ট সম্মান। 



bala-2_1742795584.jpg
bala-2_1742795584.jpg