পত্রিকা অফিস থেকে ফিরতেই দেরি হয়েছে। রাত ১১টার পরে ভন দেখবার চেষ্টা করলাম। বিজনের (বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী) প্রোফাইলে প্রথম লাল শার্ট পড়া মফিজের (মফিজুর রহমান) ছবি। লেখা আছে সন্ধ্যার পরে মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলতে খেলতে বুকে ব্যাথা, সেখান থেকে হাসপাতালে (হৃদরোগ ইনষ্টিটিউট) তারপর আর নেই, সব শেষ। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। মফিজের ছবির নিচে এমন লেখা কেন!
সংবাদটা রাতেই জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। রাত বাড়ার সাথে সাথে ফেসবুকের মাধ্যমে শত শত শিল্পীর চোখে পড়ে। মফিজের আকস্মিক মৃত্যুর খবরে সংগীত অঙ্গনে শিল্পী ও কলকুশলীদের মাঝে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। ভন-তে কোন শিল্পী-শুভানুধ্যায়ী-সংগঠন কী মন্তব্য করেছেন তা তুলে ধরলে বোঝা যাবে শিল্পী মফিজ বা ব্যক্তি মফিজ কেমন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন।
রফিক সুলায়মানÑ গভীর শোক ও শ্রদ্ধা। নজরুল ভুবন তথা বাংলা সংগীত ক্ষতিগ্রস্থ হলো। তাহমিনা মনোয়ারÑ মফিজ এটা মেনে নেওয়া যায় না। পৃথিবীর বিধান তাই মেনে নিতে হবে। মনির চৌধুরীÑ আমি গভীরভাবে শোকাহত। মহান আল্লাহপাক তাকে জান্নাত দান করুন। শাহিনা পারভীনÑ ভাইয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। সুমন চৌধুরীÑ এইটা কেমন কথা? মফিজ, ভাই কয়দিন আগেই কথা বললাম। ওরা বাচ্চারা সব অকালে বিদায় নিচ্ছে, আর কত বোঝা বইতে হবে? মুনতারিন মহলÑ গভীর শোক ও আন্তরিক সমবেদনা। মৃত্যুঞ্জয় মজুমদারÑ গভীর শোকাহত, মফিজ ভাই আপনি যেখানই থাকুন ভাল থাকুন। ঈশ^র আপনাকে স্বর্গবাসী করুন। রশিদুন নবীÑ শোকাহত। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সকলের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। সংগীতা দাসÑ শোকাহত। তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি। সুমন মজুমদারÑগভীর শোকাহত। বিদেহী আত্মার জন্য শান্তি প্রার্থনা করি। শারমিন জাহানÑ ওতো আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। নিরহংকারী, অমায়িক। আহা! বন্ধু ওপারে ভালো থেকো। মইদুল ইসলামÑ মর্মান্তিক সংবাদ। মফিজ এত তাড়াহুড়া করে চলে গেলে! ভালো থেকো ওপারে। শ্রাবন্তী ধরÑ অবিশ^াস্য ! কি হলো এটা! আত্মার শান্তি কামনা করছি। সরকারি সংগীত কলেজÑ শোকবার্তা, বিশিষ্ট নজরুল সংগীত শিল্পী, সরকারি সংগীত কলেজের নজরুল সংগীত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, প্রধান সহকারি অধ্যাপক মফিজুর রহমানের প্রয়াণে সরকারি সংগীত কলেজ পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। ড. ফকির সুমনÑ আল্লাহ, মফিজ ওপারে ভালো থেকো বন্ধু, তোমার আত্মার শান্তি কামনা করি। সলোক হোসেনÑ মেনে নেওয়া যায় না। আল্লাহ আপনাকে জান্নাতবাসী করুক। রাসেদুল হাসানÑবন্ধু ওপারে ভালো থাকিস। এই দোয়াই করি। তুই অবশ্যই ভালো থাকবি।
অনেক ভালো একজন মানুষ ছিলি তুই। প্রশান্ত কুমার মন্ডলÑ গভীর শোক প্রকাশ করছি। মঞ্জু সাহাÑ একসাথে বিটিভিতে কত প্রোগ্রাম করেছি। মফিজ ভাইয়ের আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি। প্রফেসর রিনাত ফওজিয়াÑ খবরটা শুনে মেনে নিতে পারছিলাম না কিছুতেই। মহান আল্লাহ ওকে ওপারে ভালো রাখুন। পূর্ণচন্দ্র মন্ডলÑ অসাধারন গুণী কণ্ঠশিল্পী ও সুদক্ষ শিক্ষক হারালাম। ওপারে ভাল থাকুন। তজিরুল ইসলামÑ গভীর শোক জানাচ্ছি এবং তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। শুভা মোস্তফাÑ বন্ধু মফিজ, বাক্যহারা হয়ে গেলাম। ভালো থেকো পরপারে। কেবলি কলেজের দিনগুলি স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে। নওশের কাদেরিÑ মফিজের বাড়ি আর আমার বাড়ি পাশাপাশি। মান্নাদের গান তার কন্ঠে চমৎকার রস সৃষ্টি করতো। মফিজ ওর আত্মীয় স্বজনের প্রতি অত্যন্ত যন্তশীল ছিল। অমায়িক সদা হাস্য উজ্জল মফিজকে মহান আল্লাহ শান্তিতে রাখুন। ইয়াসমীন মুশতারীÑ আমার ভীষন প্রিয় মানুষ, অনেক আদরের মফিজ, তুমি চলে গেলে ভাই? খবরটা শুনে অসহনীয় কষ্ট হচ্ছে। এই কথাটা দিন দিন আরো বেশি উপলব্ধি করছি যে, সত্যিকারের অন্তর-স্বচ্ছ প্রকৃত ভালো মানুষ বেশি দিন থাকে না। দোয়া করি মফিজ, মহান আল্লাহ তায়ালা তোমাকে বেহেসত নসীব করুন, আমীন। তারক নট্টÑ কত অনুষ্ঠানে একসাথে গান করেছি। দেখলেই জড়িয়ে ধরে বলতো কেমন চলছে নট্ট গান বাজনা। আজ দেখলাম এক এক করে সব রতœ হারাচ্ছি। আত্মার শান্তি কামনা করছি, ওপারে ভালো থাকুন। এনামুল কবিরÑ আল্লাহ রহমানির মফিজকে জান্নাতবাসী করুন, তার পরিবারের সবাইকে এই শোক সহ্য করার শক্তি দান করুন। রওশন আরা সোমাÑ বিশ^াস করতেই পারছি না, কী হয়েছিল? বড় অসময় চলে গেল। লিনু বিল্লাহÑএত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া মেনে নেয়া কষ্টকর। আলাউদ্দীন আহম্মেদÑ আমি মফিজের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। ফাহমিদা নবীÑ ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। ছন্দা চক্রবর্তীÑ আহা মফিজ ভাই কিছু লিখতে পারছি না, শুধু প্রার্থনা জানাই পরম সুন্দরের কাছে, সুরলোকে সুরের জাদুকর শান্তিতে থাকুক। আমি-আমরা সংগীত কলেজ পরিবার আজ ভাষাহীন, কষ্টে নীল হয়ে আছি সবাই। করিম শাহাবুদ্দীনÑ ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না এলাহি রাজেউন। শাহীন সরদারÑ গভীর শোকাহত, আত্মার চির শান্তি কামনা করি। ধ্রবপদ মিউজিকÑ সেদিন সরকারি সংগীত কলেজে সবার আগে মফিজের সাথে দেখা হলো, কত কথা হলো, কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। শরণ বড়–য়াÑ বন্ধু তোর জন্য প্রার্থনা ছাড়া আর কিছু করার নাইরে। ভালো থাকিস। রাহাত আরা গীতিÑ ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন। তিমির নন্দীÑ শোকাহত! তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। প্রিয়াপংকা গোপÑ মফিজ ভাই এভাবে চিরতরে হারিয়ে গেলেন ....খুব কষ্ট হচ্ছে, তবু মেনে নিতে হচ্ছে। ঈশ^র আপনার আত্মাকে শান্তি দিক। আপনার পরিবারকে অনেক ধৈর্য্য দান করুক এই শোক সইবার। হাসিখুশি এই সংগীত প্রাণ শিল্পী মানুষটি তাঁর প্রতিটি প্রিয় মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকবেন। রুপতনু শর্মাÑ ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। আত্মার শান্তি কামনা করছি। তানিম হায়াত খানÑ হায় হায়! এটা কি শুনলাম। উত্তম কুমার রায়Ñ গভীর সমবেদনা জানাই। পল্লব স্যান্নালÑ মানতেই পারছি না রে। রশিদ আল হেলালÑ এ কেমন যাওয়া মফিজ! আমাদের সবার প্রিয় মফিজ অকালেই চলে গেল আজ। তুিম যেখানেই থাকো ভালো থেকো! তোমার গান আর শুনবো না আমরা।
মফিজের সাথে আমার পরিচয় বছর ত্রিশ আগে ৯৪/৯৫ সালে। আমি নজরুল একাডেমির ছাত্র, সেই সময় একাডেমিতে নজরুলের গান ও আবৃত্তির উপর বয়সভিত্তিক বাৎসরিক প্রতিযোগিতা হতো । প্রথম প্রতিযোগিতাতেই মফিজ নজরুলের ‘নীলাম্বরী শাড়ি পড়ি নীল যমুনায় কে যায় ’ গান গেয়ে বিচারকসহ সূধীজনের দৃষ্টি আকর্ষন করে। অনেকের সাথে আমিও জানলাম সে মিউজিক কলেজের ছাত্র। আগ বাড়িয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়ালাম। কম বয়সী আমরা, তুমি থেকে তুই-তে নামতে সময় লাগেনি।
ঠিক এই সময়ের আশে-পাশে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ৩ বছর মেয়াদি একটা মেন্টোর ফেলোশিপ কোর্স চালু করেন তখনকার মহাপরিচালক সংগীত-বোদ্ধা মোবারক হোসেন খান। বিভিন্ন সংগীত প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী আমরা স্বউৎসবে কন্ঠ পরীক্ষা দিলাম। যথারীতি মফিজ আমাদের সবাইকে টেক্কা দিয়ে নিজের জায়গা দখল করে নেয়। এই ফেলোশিপের ট্রেনার ছিলেন নজরুল একাডেমির আমাদের সংগীত গুরু পন্ডিত সুধীন দাশ।
মফিজের সাথে আমার দেখা হতো কম, কিন্তু কথা হতো অনেক বেশি। একবার দেখা হলে মন খারাপ দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলে দেখি চুপ করে থাকে। শেষে বলে ফেলে, ন্যাংটাকালের এক বন্ধুর সাথে কক্সবাজারে লঞ্চ কিনে ধরা খাইছি। আমি হাসি ওর পোলাপাইন্যা দুঃসাহস দেখে। আমাকে বলে, কখনো কারো সাথে ভাগে ব্যবসা করবি না। আমি বললাম, ব্যাটা লঞ্চ তো দূরে থাক আমার ডিঙি নৌকা কেনারও পয়সা নাই। দেখা হলে আমরা সাধারনত ব্যাটা-ব্যাটা করে কথা বলতাম। এই ব্যাটা-ওই ব্যাটা ইত্যাদি ।
একটি স্মৃতি জ্বললজ্বল করছেÑ একবার প্রোডিউসার জামান ভাই (সৈয়দ জামান) বাংলাদেশ টেলিভিশনে রোজার ঈদের গান (ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে) করার জন্য অনেককে ডেকেছেন। বাইরে সেট ফেলানো হয়েছে। আমি গিয়ে দেখি মফিজ। মেকাপ নিয়ে সবাই ড্রেস-আপ করছে। আমার হাতে প্রচন্ড ব্যাথা , কিছুতেই পাঞ্জাবী পড়তে পারছি না। মফিজ বুঝতে পেরে পড়িয়ে দিলো। প্রোগ্রাম শেষে পাঞ্জাবী খুলে দিয়ে ব্যাগে ভরিয়ে দিলো। বের হবার পরে রিক্সা ঠিক করেও দিলো। এই হলো বন্ধ্ ু।
সে সময় নজরুল একাডেমি-তে আমরা যারা ছিলামÑআমি, বদিউজ্জামান বাদল, তানভির দাউদ রনি, সামিরা জুবেরি হিমিকা, মাহফুজা ইয়াসমিন পর্না, সাজিয়া রশিদ মুমু, সেলিম রেজা, মুনা, পামি, জুলিও, আরো অনেকে। বিভিন্ন দিবসে, বিশেষ করে নজরুলের জন্মবার্ষিকী-মৃত্যুবার্ষিকী এবং পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান হতো জমকালো। নিজের এবং বিশিষ্টজনদের পরিবেশনা হতো উপভোগ্য । এসময় উৎসবকে ঘিরে এক খুশির আমেজ বইতো। প্রায় প্রত্যেকের সাথে আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব আসতো। মুমুর সাথে ওর ছোট বোন কাজী ফারাহ রশিদ ইমু আসতো। এদের সবার সাথে আমার ভালো শখ্যতা ছিলো।
২০০১ সালে হঠাৎ একদিন হিমিকার মুখে শুনি মফিজ আর ইমু নিজেরা বিয়ে করেছে। পরে মফিজকে মুমু-ইমুর সাথে আমার সম্পর্কের কথা জানালে ওর চিরাচরিত ভাষায় বলেÑজানি ব্যাটা।
২০০৭ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সংগীত শিক্ষা কেন্দ্রে আমার সংগীত প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরি হয়। তারও আগে থেকে মফিজ এখানে কাজ করত। একদিন ডিপার্টমেন্টের মিটিং শেষে আমরা সবাই গানÑবাজনা করছি। মফিজ গাইলÑ ‘ও বরষা রে /সবাই তোকে বরণ করে শুধু আষাঢ়ে। আমাদের প্রিন্সিপাল প্রখ্যাত শিল্পী আব্দুল জব্বার বললেন, এই ছেলে তোমার নাম-ঠিকানা দাও। কতজনকে আমি আমার সাথে বিদেশ নিয়ে যাই। তোমাকে নিয়ে যাব। এটা মফিজের অতি যোগ্যতা। আব্দুল জব্বার মফিজকে বিদেশে নিয়ে গিয়েছিলেন কি না আমি জানি না, তবে মফিজ ঠিকই গান গাওয়ার আমন্ত্রণে ভারত, ফ্রান্স, জার্মানী, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড গিয়েছিল।
করোনার পরে ২১/২২ সালের দিকে হঠাৎ ফোন করে গালিÑব্যাটা বড়ো লেখক হয়া গেছস, তোর নাকি অনেক বই বাড়াইছে। আমি কইলাম হ’ তোরে দিমুনি। দিমুনি না , আমি কালই আইতাছি। ঠিকই পরের দিন আসলো। কথা হলো, দুজনে চা খাইলাম। আমি খুব খুশি হয়ে অনেকগুলো বই দিলামÑ‘নজরুলের সংগীত জীবন’, ‘নজরুল জীবন’, ‘শতবর্ষে নজরুলের বিদ্রোহী’ আরো কয়েকটা। মফিজ আজ নাই। তাকে ভালোবাসার ভাষা নাই। আসন্ন ২০২৫-এর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত আমার কয়েকটি বইয়ের একটি হলোÑ‘নজরুল জীবনে হাস্যরস’। প্রকাশক : জিনিয়াস পাবলিকেসন্স। প্যাভিলিয়ন নংÑ৩২। এ গ্রন্থটি মফিজকে উৎসর্গ করেছি। এছাড়া আমি ওর জন্য আর কী করতে পারি। এটি একজন লেখকের পক্ষ থেকে কাউকে দেওয়া অতি সম্মান। এ সম্মান আমার কাছ থেকে সে পেতে পারেই। কারণ সে হলো বন্ধু আমার...। য়
লেখক : গবেষক, সাহিত্য ও সংগীত ব্যক্তিত্ব
ংযধযরহঁৎসঁংরপ৭০@মসধরষ.পড়স