গ্রামোফোন শব্দটি কানে আসলে আমাদের কল্পনার চোখে একটি ছবি ভেসে ওঠে। যে ছবিতে দেখা যায় চারকোণা একটি ১৪ ইঞ্চি-বাই-১৪ ইঞ্চি বাক্স। যার উপরের পৃষ্ঠে আছে সমতল চাকতির মতো অংশ। এর উপরে শেলাক বা ভিনাইলের তৈরি সর্পিল খাঁজকাটা ধূসর রঙের রেকর্ড ডিস্ক। তার উপরে সূচযুক্ত ক্র্যাঙ্ক নামের বাঁকানো হাতল। সবার উপর সোনালী রঙের ধাতব চোঙা বা হর্ণ।
এই জনপদে এমন একটা সময় ছিল, যখন কোন বাড়িতে গ্রামোফোন যন্ত্র থাকা ছিল সেই বাড়ির সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে গ্রামোফোন ছিল এক অনন্য সংগীতযন্ত্র। সে সময়ে যন্ত্রটি ছিল অন্যতম বিনোদন মাধ্যম। গ্রামোফোন কিন্তু তখন দুষ্প্রাপ্য ছিল। দামও ছিল প্রচুর। ফলে কেবল উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষদেরই এটা কেনার সামর্থ্য ছিল। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, গ্রামোফোন শুধুমাত্র সংগীতের উৎস ছিল না, বরং এটি তখনকার সমাজে বিত্ত ও ক্ষমতার প্রতিকী চিহ্ন হয়ে উঠেছিল। ধনী ব্যক্তিরা নিজেদের ঐশ্বর্য ও রুচির উন্মুখতায় বাড়িতে গ্রামোফোন রাখতেন। অতিথিদের দেখানোর সময় চেহারায় অহঙ্কারী ভাব ফুটে উঠত। গ্রামোফোনকে অনেকে মনে করতেন একপ্রকার সামাজিক প্রতিপত্তির প্রতীক বা স্ট্যাটাস সিম্বল। সময়ের সাথে সাথে গ্রামোফোন সাধারণ মানুষের নাগালে এলেও তার সেই প্রতীকী গুরুত্ব ইতিহাসের অংশ হিসেবে থেকে গেছে।
গ্রামোফোন যন্ত্রকে অনেক পেছনে ফেলে আজকে কত রকমের গান শোনার যন্ত্র। প্রতিবছর নতুন নতুন অডিও যন্ত্র বাজারে আসছে। এক যন্ত্র থেকে অন্য একটি আরো উন্নত হচ্ছে। রেডিও, ক্যাসেট, টেপরেকর্ডার, সিডি প্লেয়ার বেশ অনেক বছর গান শুনিয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ডিজিটাল প্লাটফর্ম সংগীতের বিকাশকে সাহায্য করেছে। বিজ্ঞানীদের কল্যাণে ডিজিটাল মিউজিক প্লেয়ার থেকে স্ট্রিমিং সার্ভিস যেমন নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম টিভি, প্লুটো টিভি, স্পর্টিফাই, ফ্রিভি, ফেসবুক লাইভ, ইউটিউভ লাইভ, ইন্সটগ্রাম লাইভ, টিকটক লাইভ ইত্যাদি প্রায় শত রকম ডিজিটাল সার্ভিস জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু একথা মানতেই হবে, গ্রামোফোন ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন। বর্তমানের এতসব আধুনিক অডিও প্রযুক্তির ভিত্তি তৈরি করেছে গ্রামোফোন এবং তারও আগে ফোনোগ্রাফ। গ্রামোফোন ঐতিহ্যবাহী যন্ত্র হিসেবে সংগীত প্রেমীদের নস্টালজিক করছে।
গ্রামোফোন ১৯০২ সালে প্রথম ব্রিটিশ-ভারতে আসে। তবে এই ইতিহাস জানার আগে গ্রামোফোন কিভাবে এই মাটির পৃথিবীতে আবির্ভাব হলো এটা জেনে নেয়া মনে হয় মন্দ হয়না। ঘটনাটি ঘটে ১৮৭৭ সালে। মার্কিন মূলুকের বিখ্যাত বিজ্ঞানী থমাস আলভা এডিসন সে সময়ে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে বার্তা এবং ফোনের মাধ্যমে কথা একস্থান থেকে দূরবর্তী স্থানে প্রেরণের উপায় বের করতে টেলিগ্রাফ এবং টেলিফোন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন, টেলিগ্রাফের শব্দের কম্পনকে ধাতব পাতের উপর খোদাই করা সম্ভব। এখান থেকেই তাঁর মাথায় এক নতুন ধারণা আসে, তাহলে তো শব্দকে ধারণ করে পরে সেই শব্দ পুনরায় শুনতে পাওয়া উচিত। সহকারী ক্রিউসিকে নিয়ে এডিসন কাজে নেমে পড়লেন। কিছুদিন খাটাখাটনির পর একটি খুব সিম্পল যন্ত্র তৈরি করে ফেললেন। সেই যন্ত্র একটি স্টাইলাস বা ধাতব সূঁচ দ্বারা কাগজের বা টিনের ফয়েলের উপর শব্দ কম্পন খোদাই করতে পারে। এইভাবে মানব কণ্ঠকে ধারণ ও পুনরায় স্পষ্টভাগে শোনানোর উপায় খুঁজে পেলেন। তিনি জনপ্রিয় একটি ইংরেজি ছড়া ‘ম্যারি হ্যাড আ লিটল ল্যাম্ব’ এর কয়েকটি লাইন আবৃত্তি করে টিনের ফয়েলে রেকর্ড করেন। এরপর রেকর্ডেড ফয়েলটি আবার চালানো হলে এডিসন এবং ক্রিউসি স্পষ্ট শুনতে পেলেন যন্ত্রের ভেতর থেকে এডিসনের কণ্ঠ ভেসে আসছে “ম্যারি হ্যাড আ লিটল ল্যাম্ব”। দুজনেই অবাক ও আনন্দ-খুশিতে হাতে হাত রেখে নাচতে শুরু করলেন। তারিখটা ছিল ১৮৭৭ সালের জুলাই মাসের ১৮ তারিখ।
যন্ত্রটি আবিষ্কারের দিন এডিসন তাৎক্ষণিকভাবে ওটার নাম দিলেন ‘স্পিকিং ম্যাশিন’। এই দিনের আগে পর্যন্ত এমন ধারণা ছিল, মানুষ একবার কথা বলে ফেললে সেই কথা আর ফেরানো যায়না। বলে ফেলা কথা আর দ্বিতীয়বার শোনা যাবে না। সেইদিন বিজ্ঞানের সাফল্য এক লাফে কয়েক সোপান উপরে উঠে গেল। যেহেতু টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের গবেষণা কালে কথা ধারণ করার যন্ত্র আবিষ্কার করলেন। এডিসন তাই এর নাম দিলেন ফোনোগ্রাফ। এই খবর চাউর হতে বেশি সময় লাগেনি। প্রথমে তো অনেকে বিশ্বাসই করেনি। দলে দলে মানুষ ভিড় করে যাদুর যন্ত্রটির কেরামতি পরীক্ষা করতে আসতো। এক মাথা আশ্বর্য আর বুকভরা আনন্দ নিয়ে ফিরে যেতো।
একটা নতুন যন্ত্র আবিষ্কারের পর ঘরের কোণে ফেলে রাখা তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বিজ্ঞানী এডিসন ফোনোগ্রাফকে শ্রুতিলিপি, বই রেকর্ডিং, চিঠি ও রিপোর্টের ডিকটেশন, সংগীত সংরক্ষণ, স্বজন-বন্ধুদের বার্তা রেকর্ড, বাচ্চাদের খেলনা- এমন না না কাজে ব্যবহার করতে লাগলেন। এর পরিধি বাড়িয়ে অন্ধ মানুষদের জন্য পাঠ্যপুস্তক শোনার সুযোগ তৈরি করা এবং শিক্ষণ সামগ্রী সংরক্ষণের কাজও করতে লাগলেন। আবিষ্কারের ৫ মাস পর বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সাইন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিন’ ১৮৭৭ সালের ২২ ডিসেম্বর ফোনোগ্রাফ আবিষ্কারের কাহিনী বিশদভাবে প্রকাশ করে। সারা বিশ্বের মানুষ ফোনোগ্রাফ সম্পর্কে জানতে পারে। এর দশ বছর পরে গ্রামোফোন আবিষ্কার হয়। তবে একথা মানতে হব, আধুনিক অডিও রেকর্ডিং প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করে এডিসনের ফোনোগ্রাফ যা আধুনিক মিউজিক প্লেয়ার, ক্যাসেট, সিডি এবং ডিজিটাল রেকর্ডিং প্রযুক্তির পথপ্রদর্শক।
ফোনোগ্রাফ আবিষ্কৃত হওয়ার পর পরই গ্রামোফোন যন্ত্র আবিষ্কারের কেন দরকার পড়লো- এমন প্রশ্ন অনেকের মতো আমার মনেও আসে। আসলে ফোনোগ্রাফের বেশকিছু সীমাবদ্ধতা ছিল যা কাটিয়ে উঠতে জার্মানী থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসে স্থায়ী হওয়া এমিল বার্লিনারকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি ১৮৮৭ সালে গ্রামোফোন আবিষ্কার করে ফোনোগ্রাফের অধিকাংশ অসুবিধা দূর করেন। কার্যত ফোনোগ্রাফের ছিল বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা। টিনের ফয়েল বা মোমের সিলিন্ডার কয়েকবার বাজানোর পর নষ্ট হয়ে যেতো। দীর্ঘসময় সংরক্ষণ করা যেতো না। ফোনোগ্রাফে এককভাবে রেকর্ড করা হয় বলে একই গান বা অডিওর অনুলিপি করা কঠিন। সাউন্ড কোয়ালিটিও মানসম্মত নয়। ফলে উৎপাদন ও বাজারজাত করা যেত না। একটি রেকর্ড একবার তৈরি হলে এর একাধিক অনুলিপি করা যেতো না। ফলে ফোনোগ্রাফের বাণিজ্য সাফল্য ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়।
প্রাগুক্ত সীমাবদ্ধতাগুলো সমাধানকল্পে এমিল রেকর্ডিং এর জন্য টিনফয়েল বা মোমের সিলিন্ডারের পরিবর্তে শেলাকের ফ্ল্যাট ডিস্ক ব্যবহার করলেন যা টেকসই । শব্দ সংরক্ষণ ও পুনরায় বার বার বাজানোর ক্ষেত্রে অনেক বেশি কার্যকর। এমিলের গ্রামোফোন ব্যবহার করা ছিল সহজ। একটা ডিস্ক ইন্সটল করে বিদ্যুৎ ছাড়াই হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে গান শোনা যেতো। এমিলের ডিস্ক পুনরুৎপাদনযোগ্য। হালকা বলে সহজে পরিবহনযোগ্য এবং বাণিজ্যিকভাবে অনেক সফল। তবে শেলাক ডিস্কেরও বেশ কিছু অসুবিধা আছে। পরবর্তীতে ভিনাইল ডিস্ক আসায় সেই সমস্যাগুলো আর থাকেনা।
এমিলের গ্রামোফোনের কর্ম প্রণালীও বেশ সহজ। রেকর্ড ডিস্ক প্ল্যাটারের উপর রেখে মোটর বা ক্র্যাঙ্কের সাহায্যে ঘোরানো হয়। একই সাথে স্টাইলাস (সূঁচ) ডিস্কের খাঁজের উপর স্থাপন করা হয়। খাঁজের কম্পন স্টাইলাসের মাধ্যমে সাউন্ডবক্সে পৌঁছে। ডায়াফ্রামের কম্পন থেকে শব্দ তৈরি হয়। আর শেষে হর্ন বা স্পিকার সেই শব্দকে অ্যাম্পলিফাই করে অর্থাৎ অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
এমিল বার্লিনারের ১৮৮৭ সালে আবিষ্কৃত গ্রামোফোন উপযুক্ত মর্যাদা পায় যখন এমিল বার্লিনার এবং এল্ড্রিজ আর. জনসন যৌথভাবে ‘ভিক্টর টকিং মেশিন কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করে বাণিজ্যিকভাবে গ্রামোফোন ও রেকর্ড তৈরি ও বিক্রি শুরু করেন । এমিল বার্লিনারের গ্রামোফোন এবং এল্ড্রিজ জনসনের অটোমেটিক স্প্রিং মোটর প্রযুক্তি একত্রিত করে ১৯০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ডেলওয়্যার নদীর তীরে অবস্থিত ক্যামডেন শহরে ভিক্টর টকিং মেশিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ভিক্টর কোম্পানি উচ্চমানের গ্রামোফোন যন্ত্র ও শেলাক রেকর্ডিং ডিস্ক উৎপাদন শুরু করে, যা রাতারাতি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীতে ভিক্টর কোম্পানি গ্রামোফোন যন্ত্রটিকে কিছুটা পরিবর্তন করে ভিক্ট্রোলা নামে ইন্টিগ্রেটেড গ্রামোফোন তৈরি করে, যেখানে বড় আকারের সাউন্ড হর্নটি অনেক ছোট সাইজ করে বাক্সের ভেতরে লুকানো থাকে। সেই সাথে ৭৮ আরপিএম -এর পাশাপাশি ৪৫ আরপিএম স্পিডে চলা ডিস্ক রেকর্ড তৈরি হওয়া শুরু হয় এবং তা অতি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে যায়। অন্যদিকে অধিক বিক্রির ফলে গ্রামোফোনের দামও অনেক কমে আসে। উচ্চবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে তখন গ্রামোফোন শোভা পেতে থাকে।
ভিক্টর কোম্পানির কর্ণধারগণ বুঝতে পারেন, গ্রামোফোন যন্ত্রটি সংগীতকে আশ্রয় করলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন। তাই ব্যবসা প্রসারের কৌশল হিসেবে কোম্পানি গ্রামোফোনের সাথে সংগীতকে একীভূত করার দিকে আগায়। সেই ভাবনায় জনপ্রিয় সংগীত শিল্পীদের গান রেকর্ড করে বাজারজাত শুরু করে। সাথে সাথেই সংগীতপ্রেমী ক্রেতাগণ দেদারছে রেকর্ড কিনতে থাকেন। এভাবেই ভিক্টর পরিকল্পনামাফিক এনরিকো কারুসো, লুইস আর্মস্ট্রং, মারিয়া কলাস প্রমুখ বিখ্যাত গায়ক-গায়িকাদের সাথে চুক্তি করে বিভিন্ন উপলক্ষ্য হিসেবে রেকর্ড প্রকাশ করা শুরু করে। শিল্পের বাজারের প্রতিযোগিতায় ভিক্টর দ্রুত সামনের দিকে চলে আসে। যে শিল্পীদের রেকর্ডের চাহিদা সবচেয়ে বেশি ছিল তাদের মধ্যে প্রথমে যার নাম বলতে হয়, তিনি হলেন ইতালির নেপলসে জন্মগ্রহণকারী অপেরা গায়ক এবং সমকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ টেনর এনরিকো কারুসো। ভিক্টর কোম্পানি এনরিকো কারুসোর গানের রেকর্ড বিক্রি করে যেমন অনেক নাম কামায়, তেমনি শিল্পী কারুসোর সুপারহিট রেকর্ড হট কেকের মতো বাজারে বিক্রি হওয়ায় তিনি জনপ্রিয়তার উচ্চ শিখরে চলে যান। অর্থাৎ ভিক্টর এবং কারুসো উভয়ে উভয়ের জিৎ-জিৎ। বিংশ শতাব্দির শুরুতে কারুসোর মতো আরো বেশ কয়েকজন গানের শিল্পীর রেকর্ড বাজারে আসার বদৌলতে সংগীতপ্রেমীদের কাছে প্রচুর জনপ্রিয়তা পান। একথা স্বীকার করতে হবে, ভিক্টর টকিং মেশিন কোম্পানি শুধু গ্রামোফোনের বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বিপণনেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেনি, বরং আধুনিক সঙ্গীত শিল্পের ভিত্তিও স্থাপন করেছে। তাদের উদ্ভাবনী বিপণন কৌশল, উন্নত মানের রেকর্ড ও প্লেব্যাক প্রযুক্তি, এবং বিশ্বব্যাপী প্রসারের ফলে গ্রামোফোন একটি জনপ্রিয় বিনোদন মাধ্যম হিসেবে গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। ফলে সাধারণ মানুষ ঘরে বসেই জনপ্রিয় সঙ্গীত শুনতে পারত। এর ফলে উচ্চবিত্ত শ্রেণির বাইরে সঙ্গীতের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে গ্রামোফোনের মাধ্যমে শিল্পীদের গান রেকর্ড করে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হওয়ায় গানের সাথে সরাসরি যুক্ত শিল্পীরা যেমন খ্যাতি লাভ করতেন, তেমনি তারা আর্থিকভাবেও লাভবান হতে শুরু করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই বছর অর্থাৎ ১৯০১ সালে লন্ডনে গ্রামোফোন কোম্পানি লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার দখলের পর পরই এমিল-এল্ড্রিজ মাণিকজোড় সময় ক্ষেপণ না করে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চলে রেকর্ড বিক্রির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে আধিপত্য বিস্তার করার দিকে মনযোগী হন । তবে ইউরোপে ভিক্টর কোম্পানির গ্রামোফোন দ্রুত জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে বড় কাজ করে ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ বা এইচ.এম.ভি. ব্র্যান্ডিং। এইচ.এম.ভি. ব্র্যান্ডিং হাইলাইট করে প্রথম আউটলেট খোলা হয় লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটে। অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অল্প সময়ের মধ্যে ৩৬৫ অক্সফোর্ড স্ট্রিট সংগীত ও বিনোদন বিক্রির প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই ব্র্যান্ড সূচনার মূল কারিগর ছিলেন উইলিয়াম বারি ও ট্রেভর লয়েড উইলিয়ামস। তাদের সহযোগিতা করেন এমিলের প্রতিনিধিরা।
‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ নামটি এসেছে একটি সত্য কাহিনী থেকে। ‘নিপার’ নামের কুকুরের ছবি গ্রামোফোন শিল্পের আইকনিক প্রতীক হিসেবে পরিচিতি পায়। নিপার ছিল একটি ফক্স টেরিয়ান মিশ্রণ প্রজাতির কুকুর। এর মালিক ছিলেন বৃস্টল নিবাসী মার্ক বারো। পেশায় মার্ক ছিলেন নাট্য ম্যানেজার। কুকুরটির নাম নিপার রেখেছিলেন। কারণ সে মানুষের পায়ের গোড়ালি আলতো করে কামড়াতে পছন্দ করতো। ‘নিপ’ শব্দের অর্থ হালকা কামড়ানো। ১৮৯৮ সালে মার্ক বারো মারা যান। তখন তার ভাই ফ্রান্সিস বারো নিপারের দায়িত্ব নেন। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করেন নিপার তার প্রাক্তন মালিকের রেকর্ড করা কণ্ঠ শুনলে গ্রামোফোনের পাশে বসে থাকে। বিষয়টি তাকে গভীরভাবে সংবেদনশীল করে। তিনি নিপারের এই প্রভুপ্রেম দেখে অভিভূত হয়ে একটি পেইন্টিং তৈরি করেন, যেখানে নিপার গ্রামোফোনের সামনে বসে নিবিষ্ট মনে মার্ক বারোর কণ্ঠ শুনছে। প্রথমে পেইন্টিংটির নাম দেন ‘ডগ লুকিং অ্যাট অ্যান্ড লিসেনিং টু আ ফোনোগ্রাফ’। পরে নামটি পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’। ফ্রান্সিস বারো ১৮৯৯ সালে তার এই চিত্রকর্মটি গ্রামোফোন কোম্পানিকে দেখান। কোম্পানি দেখা মাত্র বলা যায় কোন বাক্য বিনিময় ছাড়াই কিনে নেয়। এইভাবে পেইন্টিংটি গ্রামোফোন কোম্পানির আইকনিক লোগো হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ছবিটি একটি কুকুরের প্রভুর প্রতি অমিত ভালোবাসার প্রতীক রূপে স্থায়ী হয়। এই প্রতীকে পরোক্ষভাবে মানুষকে গ্রামোফোনের মাধ্যমে সংগীতের প্রতি আবেগ ও আকর্ষণ তৈরিতে কাজ করে। এইভাবে হিজ মাস্টার্স ভয়েস শিরোনামে কুকুর নিপারের গল্প কেবল একটি ব্র্যান্ডের প্রতীক নয়, এটি একটি অনন্য শিল্পকর্ম যা সংগীত এবং প্রযুক্তির মধ্যে গভীর মেলবন্ধনের প্রতিচ্ছবি। এই ছবি সারা পৃথিবীব্যাপী গ্রামোফোন, রেকর্ডিং শিল্প এবং আধুনিক সংগীতের একটি স্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে আজও বেঁচে আছে। গ্রামোফোন বৃটেনে আসার পর ব্রিটিশ-ভারতে প্রবেশ করতে সময় লাগেনি। ভারতে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখেন গ্রামোফোন রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার আর্ল উইলিয়াম আইসবার্গ। ১৯০২ সালে কলকাতায় কোম্পানি তাদের ভারতীয় শাখা স্থাপন করে। ঐ একই বছর গ্রামোফোন কোম্পানি কলকাতায় একটি রেকর্ডিং সেশন আয়োজন করে। বিখ্যাত ভারতীয় সংগীত শিল্পী গওহর জান ছিলেন প্রথম ভারতীয়, যাঁর গান রেকর্ডের মাধ্যমে ভারতবর্ষে গ্রামোফোন যাত্রা শুরু করে। গানটি ছিল ‘তোমরা সব গীত শুনো’। গওহর জান ছিলেন ধ্রুপদী সংগীত ও ঠুমরি গানের কিংবদন্তি শিল্পী। অভিনব গায়কীর জন্য তিনি সেসময় ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর পরিবেশিত ঠুমরি ‘রসকে ভবন মরি পেয়ারি’ এবং কাজরি গান ‘পিয়া বিন নাহি আউর কে সঙ্গ’ অনেক বছর ধরে শ্রোতাদের মুগ্ধতায় ভরিয়ে রেখেছিল। কোলকাতা জয় করে কোম্পানি শীঘ্রই বোম্বে, মাদ্রাজ, ও দিল্লির মতো বড় শহরগুলোতে গ্রামোফোন ও ডিস্ক রেকর্ড বিক্রি শুরু করে। এইভাবে গ্রামোফোন কোম্পানির কার্যক্রম ব্রিটিশ-ভারতের সংগীত শিল্পে এক নতুন যুগের সূচনা করে। সে সময় গ্রামোফোন বলতে মানুষ বুঝত এইচ.এম.ভি.। তবে অনেক পথ পেরুনোর পর ২০০০ সালে এইচ.এম.ভি.সারেগামা ইন্ডিয়া লিমিটেড নামে রূপান্তরিত হয়।
ভারতীয় প্রাচীন সংগীত থেকে আধুনিক সঙ্গীতে উত্তরণে গ্রামোফোন মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। তাছাড়া গ্রামোফোন বাংলা, হিন্দি, উর্দু ছাড়াও আরো অনেকগুলো ভাষায় যেমন সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালয়ালম, গুজরাটি, মারাঠি, পাঞ্জাবি, অসমিয়া, ওড়িয়া, সংথালি, নেপালি, পশতু, বালুচি ইত্যাদি ভাষায় গান রেকর্ড করে ব্রিটিশ-ভারতের সংগীতের উৎপাদন, প্রসার, এবং গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। এইসব ভাষায় মূলত শাস্ত্রীয় সংগীত, লোকসংগীত, নাট্যগীতি, কীর্তন, ভজন, গজল, ও অন্যান্য স্থানীয় সঙ্গীত রেকর্ড করা হয়েছিল যা তখনকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সাড়ম্বরে ফুটিয়ে তোলে।
গ্রামোফোনের মাধ্যমে সঙ্গীত শুধু একটি শিল্প নয়, বরং একটি প্রধান বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ডিস্কের আকার ১০ ইঞ্চি থেকে ১২ ইঞ্চি আর প্রথম দিকে রেকর্ডে গানের দৈর্ঘ্য ৩ থেকে ৪ মিনিট ছিল। শিল্পীদের সেই হিসেব করে গাইতে হতো। শিল্পীর নাম এবং গানের প্রথম কলি ডিস্কের কেন্দ্রে ছাপানো থাকতো। এটি ব্রিটিশ-ভারতের জনগণের জীবনে সাংস্কৃতিক এবং বিনোদনের উপাদান যোগ করেছিল। আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। গ্রামোফোন কোম্পানির মাধ্যমে একটি কাঠামোবদ্ধ সঙ্গীতশিল্পের জন্ম হয়। এতে সঙ্গীত রেকর্ডিং, প্রকাশনা এবং বিপণনের একটি নতুন পেশাগত পরিকাঠামো তৈরি হয়, যা শিল্পীদের সঙ্গীতজগতে পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করে। গ্রামোফোন বাংলা গানের উন্নয়ন এবং প্রসারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গ্রামোফোনের মাধ্যমে রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত এবং আধুনিক বাংলা গান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গ্রামোফোনে রেকর্ড হওয়ার কারণে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা এবং সংগীত সাধারন মানুষের কাছে পৌঁছায়। এর মাধ্যমে বাংলা গান আঞ্চলিক গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়। বাংলা লোকসংগীত, যেমন ভাটিয়ালি, বাউল, এবং ভাওয়াইয়া গান গ্রামোফোনের মাধ্যমে নতুন জীবন পায়। এই গানগুলো আঞ্চলিক পরিবেশ থেকে বেরিয়ে বড় শহর এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চেও জনপ্রিয় হয়। একইভাবে গ্রামোফোন সংগীতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। এটি সংগীতকে গণমানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি সংগীতের গৌরবময় ঐতিহ্যকে সুরক্ষিত ও প্রসারিত করতে অমূল্য ভূমিকা রেখেছে। গ্রামোফোন এসেছিল বলেই আধুনিক রেকর্ড প্লেয়ার এবং পরে ডিজিটাল সংগীত প্লেয়ার পর্যন্ত প্রযুক্তির বিবর্তন ঘটেছে। সময়ের সাথে সাথে রেডিও, টেপ রেকর্ডারের যুগ পার হয়ে আজ এতো এতো মিউজিক সিস্টেম, সংগীত স্ট্রিমিং। তারপরেও কিছু গানপ্রিয় সৌখিন মানুষ এই সমাজে আছেন, যারা ছুটির দিনে অলস বিকেলে বাতায়ন পাশে আরাম কেদারায় বসে মখমলের উপাধানে মস্তক ডুবিয়ে গ্রামোফোনের প্ল্যাটারের উপর সাড়ে তেত্রিশ-আরপিএম ভিনাইল ডিস্ক চাপিয়ে মান্না দের রেকর্ড ‘এই কূলে আমি ঐ কূলে তুমি,মাঝখানে নদী ঐ বয়ে চলে যায়’ কিংবা ওস্তাদ গোলাম আলীর কণ্ঠে ‘চুপকে চুপকে রাত দিন আসুঁ বাহানা ইয়াদ হ্যায়” শুনে পরম শান্তিতে আধবোজা নয়নে মনকে নিয়ে যান সূদুর অতীতে। যেখানে নেই কোন হল্লা কোলাহল। নেই কোন স্বার্থের সংঘাত। য়