বাংলাদেশ বেতারে ‘বিশেষ শ্রেণী’ ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘উচ্চ শ্রেণী’ শিল্পী হিসেবে সংগীত পরিবেশন করছেন গুণী কণ্ঠশিল্পী শিপ্রা ঘোষ। এছাড়া, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির তালিকাভুক্ত শিল্পী তিনি। তার জন্ম পাবনা জেলার বেড়া উপজেলায় বিশাল এক সংগীত পরিবারে। শিশুকাল থেকেই সংগীতের পরিবেশে বেড়ে ওঠেন তিনি। বাবা স্বর্গীয় তারাপদ রায় এবং মা স্বর্গীয় গৌরাঙ্গিনী রায় তখনকার সময়ে স্কুল শিক্ষক ছিলেন। তা সত্ত্বেও সংগীতের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন এবং নিয়মিত সংগীত চর্চা করতেন তারা। গুণী এ শিল্পীর বিয়েও হয়েছে আরেক সংগীত অনুরাগী পরিবারে। তার শ্বশুর মহেষ চন্দ্র ঘোষ গান গাইতেন। স্বামী মধুসূদন ঘোষও সংগীত উস্তাদের কাছে গান শিখেছেন। শিল্পী শিপ্রা ঘোষ বলেন, ‘বাবা নজরুল সংগীত ভালো গাইতেন। মা পঞ্চকবির গান খুব ভালো গাইতেন। এখন আমরা সব ভাই-বোনই গানের সাথে জড়িত। আমি ছোটবেলায় মনে করতাম গান গাওয়া বোধহয় একটি বিশেষ বিষয়। এভাবেই পারিবারিকভাবে সুরের সাথে ভালোবাসা। ৮ ভাই-বোনের মধ্যে ৫ জন বেতার টেলিভিশনের বিশেষ শিল্পী। বড় দাদা তরুণ রায় বাংলাদেশ বেতার ঢাকা কেন্দ্রের বার্তা বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। দুই বোন দীপ্তি রাজবংশী, ফুল রেনু রায় বাংলাদেশের বিশিষ্ট লোকসংগীত শিল্পী। ছোট ভাই বরুণ রায়ও বেতার টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী। অন্য ভাই-বোনেরা গানের সাথেই জড়িয়ে আছেন।’
গানের শিক্ষা বিষয়ে শিল্পী শিপ্রা ঘোষ বলেন, ‘মূলত গান পারিবারিকভাবে শেখা। বড় দাদা-দিদিদের রেওয়াজ করতে দেখতাম, তখন তাদের কাছে বসে শিখতাম। প্রায় প্রতিদিনই বাবা আমাদেরকে নিয়ে গান গাইতে বসতেন। বিশাল উঠান ছিল বাড়িতে। জোৎনা রাতে কিংবা হারিকেনের আলোয় পড়ালেখার পর গান গাওয়ার একটা আলাদা আনন্দ ছিল। যা এখন ঐ স্মৃতিটা বার বার মনে করিয়ে দেয়। এরপর উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে ঢাকায় এসে বড় দাদা তরুণ রায়ের বাসায় উঠি। ঢাকায় পড়ালেখার পাশাপাশি ১৯৮৬ সালে তৎকালীন রেডিওতে পাশ করি। তখন থেকেই উচ্চ পর্যায়ে গানের যাত্রা শুরু। দাদা তরুণ রায় কণ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা এবং তখন দেশের একমাত্র সংগীত পত্রিকা ‘মাসিক সংগীত’ তার বাসা থেকে প্রকাশ হত। এই কারণে দেশের বিশিষ্ট শিল্পীদের আনাগোনা ছিল বাসায়। এই সুবাদে মঙ্গল চন্দ্র মঙ্গল দার কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত, ইরাহুম আলী খান ভাইয়ের কাছে নজরুল গীতি, বড় দুই দিদি দীপ্তি রাজবংশী এবং ফুল রেণুর কাছে লোকসংগীত প্রাথমিকভাবে শিখি। পরে মেঝ জামাইবাবু দেশের বিশিষ্ট লোকসংগীত শিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশী কাছে লোকসংগীত চর্চা করি। এছাড়া, শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ আক্তার সাদমানির কাছে কিছুদিন উচ্চ পর্যায়ের উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখার সুযোগ হয়েছিলো। ’
সংসার ও গান নিয়ে আক্ষেপ করে শিপ্রা ঘোষ বলেন, ‘গান-সংসার দুটোই সমানভাবে চলছে। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও পিএইচডি সম্পন্ন করেছে। আর একমাত্র ছেলেটি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। বর্তমানে গানই আমার আরেকটি সন্তান। আমি মনে করি, আমি যে গান গাইতে পারি এটাই আমার বড় অর্জন। ভারতে কয়েকবার গান করে প্রশংসা পেয়েছি। আমি বাংলাদেশ বেতার ঢাকা কেন্দ্রের বিশেষ শ্রেণীর লোকসংগীত শিল্পী ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের উচ্চ শ্রেণীর শিল্পী
হিসেবে ঐ উচ্চ শ্রেণীতেই বসে আছি। এটাই কষ্ট লাগে। আর বেসরকারী টেলিভিশনে প্রোগ্রামে না পাওয়ার কারণ হলো আমি সেভাবে যোগাযোগ করতে পারি না তাই।’
মঞ্চে গান করতে বেশি ভালো লাগে। দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়েছি। আর বাংলাদেশ শিশু একাডেমির সিনিয়র সংগীত প্রশিক্ষক উত্তরা মাখায় হিসেবে আছি। আমার সবচেয়ে ভালো লাগার জায়গা শিশুদেরকে নিয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে। শিল্পী শিপ্রা ঘোষ তার ভালো লাগা বিষয়ে বলেন, ‘গানের পাশাপাশি আমি প্রকৃতিকে খুব ভালোবাসি। গাছ আমার প্রচুর প্রিয়। গাছে যখন নানান ফুল ফোঁটে খুব ভালো লাগে। এছাড়া গান গাইতে ভালো লাগে তাই আমার নিজের উদ্যোগে ইউটিউবে ———— শিরোনামে একটি গানের চ্যানেল খুলেছি। নিজের সাধ্যমত কিছু গান করে চ্যানেলটিতে ছেড়ে দেই এটাই আমার গান গাওয়ার আরেকটা চেষ্টা। সবশেষে তিনি বলেন, দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিকাশে লোকসংগীতের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। অঞ্চল বিশেষ লোক সমাজেকর সামগ্রিক প্রতিচ্ছবি। সেই আঞ্চলের লোকসমাজের মানুষের আচার-আচরণ ও মনোভাবের পরিস্ফুটন ঘটে লোকসংগীতে। লোক সংগীতে জড়িয়ে আছে, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের কৃষ্টি, কালচার, রীতিনীতি, জীবন সংগ্রাম, কর্ম, ধর্ম, বিশ্বাস আচার-অনুষ্ঠান। আবার লোকসংগীত কেবল, ব্যীক্ত, অঞ্চল, বা সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধেও তা দৃশ্যমান। লোকসংগীতের বিশেষ বৈশিষ্ট হলো জীবন ঘনিষ্ঠ এ রচিত হয় সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। আমাদের বাংলাদেশে লোক গানের যে বিশাল ভান্ডার একেক অঞ্চলে এক কিংবা একাধিক মহাজন রয়েছেন, তাদের অফুরন্ত গানের ভান্ডার থেকে একা কিছু সংগ্রহ করাও খুব কষ্ট। এত বিশাল ভান্ডার আমাদের দেশে।