কুমিল্লার পপ ব্যান্ড র্যাকলেস সিঙ্গার্স-এর শুরুর কথা
-ফরিদ মুজহার
তারিখটি স্পষ্ট করে মনে করতে পারছি না তবে সনটা ছিল ১৯৭৪। আমরা সবাই তরুণ নবীন, প্রাণভরপুর। সদ্য স্বাধীন দেশ, বারুদের গন্ধ বাতাসে। নতুন পতাকার মতো উড়ছে মানুষের চেহারা। রাজনীতিকরা দেশের নায়ক। মুক্তি যুদ্ধের গল্প চারিদিকে। নতুন দেশ পেয়েছি কিছু একটা করার উদগ্র বাসনা। রেকর্ডে গান বাজে যুদ্ধকালীন সময়ের, চলচ্চিত্রে আসছে মুক্তি যুদ্ধের গল্প, একটা উৎসব আর প্রাপ্তির মেলবন্ধন। এই সময়ে গান বেজে উঠে ইথারে নতুন বুননে নতুন কথা সুর, গায়কী। আজম খান গেয়ে উঠেন ওরে সালেকা ওরে মালেকা। ব্যান্ড উচ্চারণ আবির্ভূত হয় তুমুল জনপ্রিয়তায়। ঢেউ জাগে সারা দেশে, তৈরি হয় স্পন্দন, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ ফকির আলমগীর, প্রমুখ গায়ক, গায়কী, সুর, বাংলা গানের নতুন জগত। পাশ্চাত্যে তখন রোলিং স্টোন, মিক জিগার, রিঙগো সটার, জর্জ হ্যারিসন, বিট্লস এর জয় জয়কার। কুমিল্লায় এর বাতাস এসে লাগে। সহপাঠী বন্ধু যাওয়েদ এজাজ মোহসেন, যে আওয়ার লেডি ফাতিমা কনভেন্ট স্কুল থেকেই আমার বন্ধু। অরগানাইজ করতে শুরু করে গানের ব্যান্ড। বন্ধুদের মধ্য থেকে বেছে নেয় অনেককে। হ্যান্ডস্ হিসেবে বেছে নেয় বজলুর রশীদ খোকন, মোহাম্মদ আলী বদরু, মোহাম্মদ তৈয়ব, পারভেজ হায়দার, মনোয়ার হোসেন টুটুল, জারিফ সাত্তার ঝুমঝুম, মোহাম্মদ সাবের আলাউদ্দিন তালুকদার, সুহাস রায়, জিয়াউল আহসান, জামাল রুমি আর দলের ম্যানেজার হিসেবে নিয়োজিত হয় খায়রুল আলম খসরু। পরবর্তী সময়ে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হন তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজী আখতার উদ্দিন বাবলু ভাই, আলী হোসেন চৌধুরী, আনোয়ারুল হক, রেজাউল করিম শামিম, হাসান ফিরোজ, বাবুল ইসলাম, শামসুল আলম, শাহজাহান হাসান, রেজা সায়ীদ, শাহজাহান চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী, মাহবুবুর, রশীদ আরিফ, মিনি খন্দকার, সাইফ আহমেদ, নবাব বাড়ীর তারেক সৈয়দ মোহসিন মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে হাবলু এসে আমাদের উৎসাহ দিতেন। ভোকাল হিসেবে নেন নাসিন মোহসেন, সবিতা সিগমা, স্বপ্না দিলশাদ, ইমদাদ মানিক, শুক্লা রায়, শোভনা রায়, আজরা নাফিসা, স্বপ্না আর মেল ভোকাল, লিড ভোকাল হিসেবে ফরিদ মুজহার। মিলন আহমেদ ভাই প্রতিষ্ঠাতা সংগীত দল রিদম অর্কেষ্ট্রার টেকনিক্যাল সাপোর্টে র্যাকলেস সিঙ্গার্স গঠন সহজ হয়। র্যাকলেস সিঙ্গার্স ব্যান্ড গঠনে প্রথম বৈঠকটি হয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর সিরাজুল ইসলাম সাহেবের রানীর দিঘির পাড়ের দক্ষিণ পশ্চিম কোনার একতলা সরকারি ভবনে। স্যারের ছেলে খোকনের রুমে। উপস্থিত ছিলেন যাওয়েদ, আলাউদ্দিন, তৈয়ব, পারভেজ ভাই, খোকন, বদরুল, সাবের, খসরু, আমি প্রমুখ। যাওয়েদ ব্যান্ড গঠনের প্রস্তাব দেয়, নামকরণে নানাজনের নাম বিবেচনায় এনে সাবেরের দেয়া নাম র্যাকলেস সিঙ্গার্স নামটি গৃহীত হয়। তৈরি হয় র্যাকলেস সিঙ্গার্স। খোকনের হলো স্পেনিশ গীটারের রিদম বাজিয়ে নিজেরা কিছু গান গেয়ে র্যাকলেস সিঙ্গার্স নামটিকে সেলিব্রেট করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় নিজেদের গান তৈরি, সুরারোপ, ইন্সট্রুমেন্টাল সাপোর্ট, রিহার্সেল, ফিনান্স, ইত্যাদি নিয়ে। আমরা সবাই তখন কলেজ ছাত্র। যাওয়েদ প্রচন্ড উদ্যোমী ছেলে অনেক কিছুর দায়িত্ব নেয় সে এবং রিহার্সেলর জন্য তার মৌলভীপাড়ার বাসাকে নির্ধারণ করা হয় এবং রিহার্সেলে উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুরোধ করে। লাইনআপ ঠিক হবে রিহার্সালের দিন বলে সেদিনকার মতো আলোচনা শেষ হয়, আমরা ক’জন রানীর দিঘির পাড়ে শহীদ মিনারের চত্বরে আবার গান গাওয়ার আসর বসাই। কিছু স্বপ্নবাজ গান মুখর তরুণ একত্রিত হলো গান নিয়ে একটা কিছু করবে। প্রচলিত ধারা ভেঙে সারগাম ঠিক রেখে গানকে দেবে নতুন মাত্রা। কুমিল্লা তখন আলো আঁধারির শহর জোনাকির শহর, উঁচু উঁচু স্কাইস্ক্রেপার আকাশকে লুট করে নেয়নি, গাছ, পুকুর, কংক্রিটের রাস্তায় টিমটিমে মিউনিসিপালিটির বাতি। বড় বড় গাছ, পাখিদের অভয়াশ্রম। অক্সিজেন ভরপুর বাতাস। শহরজুড়ে চেনা মুখের সৌজন্যতা। এরকম একটি নতুন দেশের জেলা শহর প্রাদেশিক জেলা শহরের কাপড় বদলাতে পারেনি। তারুণ্য নতুনের, তারুণ্য নবযুগ সূচনার জন্য উন্মুখ। র্যাকলেস সিঙ্গার্স এমন একটি চালচিত্র বুকে নিয়ে শুরু করে পথচলা। সসীম সম্পদ, আর্থিক অসচ্ছলতা নিয়ে মনের অদম্য অভিপ্রায় নিয়ে র্যাকলেস সিঙ্গার্স-এর অভিযাত্রা। ব্যান্ড গঠনে ন্যূনতম উপাদান সমূহ লীড রিদম ব্যাজ গীটার বলতে যাওয়েদের ইলেকট্রিক হাওয়াইন গীটার, যা লীড গীটার হিসেবে বাজানো হবে আর খোকনের ইলেকট্রিক হাওয়াইন গীটার রীদম গীটার হিসেবে বাজানো হবে। ব্যাজ বলতে হলো স্প্যানিশ গীটার। ব্যাজ গীটার বাজাবে যুমঝুম, পরবর্তী সময়ে জামাল, রুমি। ড্রামসেট নেই যোগাড় করা হলো জিলা স্কুলের ড্রামসেট, যেগুলো স্কুলের প্যারেডে বাজানো হতো। সাইড, ট্যানো, বিগড্রাম নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে ড্রাম বানিয়ে ট্যানো আর সাইড বিগ ড্রাম মিলিয়ে প্রদর্শনযোগ্য ড্রামসেট বানানো হলো। প্রথমে বাজিয়েছিলো জারিফ ও পরবর্তী সময়ে সুহাস সাপোর্টিং হিসেবে বঙ্গো, মারাক্কাস, আর টাম্পুরিন। বঙ্গো বাজানোর দায়িত্ব নিলেন পারভেজ ভাই পরবর্তী সময়ে জাহিদ, মারাক্কাস বাজাবে বদরু, টাম্পুরিন বাজাবে তৈয়ব। পরববর্তী সময়ে টুটুল লীড গীটারের সাথে যুক্ত হয়। লীড ভোকালের দায়িত্ব ফরিদ অন্যান্য ভোকাল, সাবের, আলাউদ্দিন, দিল নাশিন, সিগম্যা, স্বপ্না, সবিতা। পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয় দিলশাদ, মানিক। ব্যানডের ম্যানেজার করা হলো খসরুকে। পরবর্তী পর্যায়ে আরো অনেকে র্যাকলেস সিঙ্গার্স-এ যুক্ত হয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গাইড ও সঞ্চালক হিসেবে কাজী আখতারউদ্দিন বাবলু ভাই। নিজেদের গ্রুপের গান বাঁধতে হবে। সুর দিতে হবে এবং ইন্সট্রুমেন্টের বিন্যাস ঘটাতে হবে। ব্যান্ড করার অভিজ্ঞতা কারোই তেমন নেই, তবে যাওয়েদ সাহসী দৃঢ়চেতা। ও হলো আমাদের প্রাণভোমরা। রিহার্সালের প্রথম দিন-গায়ক, গায়িকা, হ্যানডস সব নবিশ। ওস্তাদজীর কাছে গান শিখেনি কেউ তবুও গাইতে হবে নবীন নতুন গায়কী ঘরানায়। শুধু যাওয়েদ গীটার শিখেছে ওস্তাদ মিলন ভাইয়ের কাছে। দুপুরের আগেই তরুণ তুর্কি কুশলিবরা জড়ো হলো মৌলভীপাড়ায়, চোখে মুখে নতুন কিছু করার প্রত্যয়। যাওয়েদ ব্রীফিং দিলো, মনযোগ দিয়ে শুনলো সবাই। উপস্থিতি জমজমাট। দিল নাশিন মোহসেন- ভোকাল, স্বপ্না- ভোকাল, সিগম্যা- ভোকাল, সবিতা- ভোকাল, আলাউদ্দিন- ভোকাল, ফরিদ মুজহার- লীড ভোকাল, যাওয়েদ এজাজ মোহসেন -লীড গীটার, বজলুর রশীদ খোকন- রিদম, ঝুমঝুম- ব্যাজ গীটার, বঙ্গো- পারভেজ হায়দার, টামপুরিন- মোহাম্মদ তৈয়ব, মারাক্কাস- মোহাম্মদ আলী বদরুল, ড্রাম- জারিফ সাত্তার। সরগরম হয়ে উঠেছে রিহার্সাল রুম, চা আসছে হারমোনিয়াম বাজছে, গীটার বাজছে এম্পলিফেয়ার চড়ছে সে এক বিশাল মুহূর্ত। আরো গান তৈরী হলো সলো, গ্রুপ তাহার সঙ্গে আমার দেখা হইয়াছে আারশিনগর মনের মাঝে ধরা পইরাছে মানুষের কি হাল আরে দেখো আজকাল পথ হারাইয়া কিছু মানুষ হইয়াছে বেসামাল এটা আমাদের গ্রুপের গান তৈরী হলো প্যারোডি ধাঁচের রক গান। আমরা নিয়মিত রিহার্সাল চালিয়ে গেলাম যাওয়েদের বাসায়। তবে এর মধ্যে আমরা পারফরম্যান্স এর প্রস্তুতি মুল্লুক কাজ গুলো চালিয়ে গেলাম খোকনের বাসায় তথা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ড. সিরাজুল ইসলাম সাহেবের বাসায়। কুমিল্লা মহিলা কলেজের প্রোগ্রামের হাতে লেখা ইংরেজি পোস্টার সাঁটা হলো শহরের বিভিন্ন প্রমিজিং যায়গায়। কতোগুলো কৈশোর পার হওয়া যুবক ব্যান্ড দলের প্রোগ্রাম করবে মেয়েদের কলেজে রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এটা স্বার্থক হয়েছিলো কতিপয় শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাবিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, সহযোগিতা এবং নতুন কিছু সৃষ্টির উদ্যোম দেখে। পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষবিদরা হলেন যথাক্রমে ডক্টর মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, অধ্যক্ষ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, কুমিল্লা; এ, এইচ, এম মোহসেন অধ্যক্ষ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কোটবাড়ী, কুমিল্লা; মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন আহমেদ, প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ কুমিল্লা মহিলা সরকারি কলেজ, কুমিল্লা-এই তিন অসামান্য ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন ভাবে আমাদেরকে উপদেশ, প্রণোদনা, উৎসাহ জুগিয়েছেন। এই তিনজনই আমাদের সম্মানিত স্যার, শিক্ষাগুরু। ডক্টর সিরাজুল ইসলাম স্যার আমাদেরকে উৎসাহ যুগিয়েছেন তাঁর মেজো ছেলে বজলুর রশীদ খোকন আমাদের গ্রুপের রিদম গীটার বাজাতেন এবং তার রুম থেকে আমাদের দাপ্তরিক সুবিধাদি প্রদান করতেন। এটা একটি ২৪ ঘণ্টা খোলা রুম আমাদের অফিস কাম রেসিডেন্সই নয় একধরনের হোম বলা যায় যেখানে খাবার দাবার পরিবেশনা করতেন খালাম্মা। অনেক সময় মাইক্রোফোনে আমাদের কেউ অসংকোচে খাবার চাইতো, খালাম্মা স্নেহ মাখা খাবার পাঠিয়ে দিতেন, যে ক’জন ওখানে থাকতাম। স্যার খালাম্মা দু’জনেই চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। আমরা তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করি। অনুষ্ঠান পারফর্ম করার দিন ঘনিয়ে আসছে আর তরুণ কিছু প্রাণ জমাট বাঁধছে। একধরনের চাপ, উত্তেজনা পারফর্মারদের ভেতরে। যেমন ছেলে গাইয়ে, তেমন মেয়ে গাইয়েরা, হ্যান্ডসরা সবাইয়ের গায়ে একধরনের উত্তাপ। উইমেন্স কলেজে প্রোগ্রামের আগে সবাই মিলে ডক্টর মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম স্যারের সঙ্গে দেখা করলাম এবং তার শুভকামনা চাইলাম।
নির্ধারিত দিন টান টান উত্তেজনা। আমাদের মেয়েরা পরীর মতো সাজগোজ, সবকটা মেয়েই সুন্দরী স্মার্ট। তারা টেনশন ফ্রী, মনে হয় ডানা মেলবে আকাশে। সবাই দিলনাশিন মোহসেন ভাইয়ের বান্ধবী, স্বপ্না, সিগমা, সবিতা। আমরা যাওয়েদের নেতৃত্বে তৈরি, উপস্থিত আছি সবাই। লীড গীটার হাতে যাওয়েদ, রিদম গীটারে খোকন, ব্যাজ গীটার এ ঝুমঝুম, মারাক্কাস হাতে বদরুল, টামপুরিন নিয়ে তৈয়ব, বঙ্গ নিয়ে পারভেজ ভাই ড্রামার জারিফ সাত্তার। তরুণ তারুণ্য দেহ মনে। আমরা সবাই স্টেজে, ম্যানেজার খসরু অনুষ্ঠান উপস্থাপনের জন্য আটঘাট বাঁধছে। যাওয়েদ স্টেজে তার ইন্সট্রুমেনটের স্কেল ঠিক করে নিচ্ছে অন্য হ্যানডসদের সঙ্গে। মাইক্রোফোন, চেক হচ্ছে এম্পলিফায়ার সেটিং করছে, বিচিত্র শব্দ তৈরী হচ্ছে, সে এক মহাযজ্ঞ। সাজ সাজ রব, কলেজ অডিটোরিয়াম মেয়ে দর্শকদের দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ। যে যার পজিশন নিয়ে দাঁড়ানো।
ম্যানেজার খসরু র্যাকলেস সিঙ্গার্স-এর প্রথম প্রোগ্রাম সূচির উদ্বোধন ঘোষণা করলো। করতালি হলো মেয়েদের মধ্যে, কিছুটা হুল্লোড়। একটি অন্যরকম অনুভূতির বিচ্ছুরণ হলো মঞ্চ জুড়ে, মঞ্চ অডিটোরিয়াম জুড়ে একটি নতুন ইতিহাস, নতুন কাহিনী রচিত হলো, অডিয়েন্স পারফর্মারদের মধ্যে সৃষ্টি সুখের একটি মেলবন্ধন তৈরী হলো। চক্রান্তকারীদের মুখে দুয়ো দিয়ে যাত্রা হলো শুরু। অভিষেক হলো কুমিল্লার প্রথম পপ ও রক গানের ব্যান্ড র্যাকলেস সিঙ্গার্স।
আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। পরবর্তীতে যা হবার তাই হয়েছে। বেশ ক’বছর জমজমাট চলার পর একে একে সবাই বিভিন্ন কারণে, পেশার তাগিদে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আজ সবই শুধু স্মৃতি। য়