১৮৯৯ সালে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। নজরুলের জন্মের মধ্য দিয়ে সার্বিক অর্থে এ দেশের সত্যিকারের জাগরণের দ্বার উন্মোচিত হয়। ১৮৯৯ থেকে ১৯২১ এই ২২ বছরকে বলা যায় নজরুল প্রতিভার প্রস্তুতিকাল। আমরা দেখব এই ২২ বছরে বিচিত্র সব পথে অসম্ভব এবং অবিশ্বাস্য পরিক্রমণের মাধ্যমে অর্জন করেছে বিপুল বিশাল অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতার বিশাল ভান্ডার ও সর্বগ্রাসী পঠনপাঠনের মাধ্যমে খুঁজে বের করেছেন সমাধানের পথ। আর নজরুল ক্রমাগত নজরুল হয়ে উঠেছেন। ব্রিটিশবিরোধী খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের গনগনে দিনে বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব। নজরুল জানতেন কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে। কোথায় হানতে হবে আঘাত। ফলে এলাম দেখলাম জয় করলামের মতো হয়ে গেল বিষয়টি। কারণ যে কবির জন্য, যে সাহসের জন্য, যে অনুপ্রেরণার জন্য, যে যুদ্ধ ঘোষণার একজন নকিবের জন্য জাতি অপেক্ষা করছিল-সেই প্রার্থিত, কাঙ্ক্ষিত কবি ছিলেন নজরুল। সাহিত্যে তখন আগুনের ফুলকি ছিটাচ্ছেন একা নজরুল। অচিরকালের মধ্যে নজরুল হয়ে উঠলেন জাতির মূল কণ্ঠস্বর। জাতির নায়ক। মাত্র ৮ বছর সময়ের মধ্যে ভয়াবহ এবং বিস্ময়কর সব কীর্তি স্থাপন করে স্তম্ভিত করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদকে। নজরুলের আবির্ভাবের ৮ বছর পর অর্থাৎ ১৯২৯ সালে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ৩০ বছরের নজরুলের গলায় পরিয়ে দেওয়া হলো জাতীয় কবির সম্মান। আর অনুষ্ঠানের সভাপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ঘোষণা করলেন, ফরাসি বিপ্লবের সময় ফরাসি জনগণ যেমন রুশো ভলটেয়ারের লেখা পাঠ করে এক একজন অতি মানবে পরিণত হয়েছিল, তেমনি নজরুলের লেখা পাঠ করেও আমাদের জনগণও একদিন অতি মানবে পরিণত হবে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস বলেছিলেন, আমরা যখন যুদ্ধে যাব তখনো নজরুলের গান গেয়ে যুদ্ধে যাব, কারাগারে যাওয়ার সময়ও গাইব নজরুলের গান। এরও বহু পরে মওলানা ভাসানী যখন শোষণবিরোধী সংগ্রাম চালাচ্ছেন তখন তিনি বলেছিলেন, অন্য অনেককে ছাড়া আমাদের চলে কিন্তু নজরুল ছাড়া আমাদের চলে না। কারণ নজরুলের প্রতিটি রচনা আসলে এক একটি যুদ্ধ ঘোষণা। এ যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। আমাদের জনগণের পরম পাথেয় নজরুলের রচনা, তার কবিতা ও সংগীত। আজার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নেতাজি সুভাষ এবং মওলানা ভাসানীর প্রতিটি কথাই সত্যে পরিণত হয়ের্ছিল। দেশের স্বাধীনতার জন্য, জনগণের মুক্তির জন্য নজরুল তার জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। কিন্তু পেছনে রেখে গেছেন যে অবিস্মরণীয় সৃষ্টি সম্ভার; যার আলো ও উত্তাপ যুগ যুগ ধরে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের দেখাবে পথ, জোগাবে অনুপ্রেরণা। এ কথা গতকাল যেমন সঠিক ছিল আজও তাই আছে। আগামীকালও তাই থাকবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমরা নজরুলচর্চা করব । আমাদের সন্তানরা তাই তো নজরুলের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অকাতরে ঢেলে দিয়েছে বুকের রক্ত। সর্বশক্তি দিয়ে উৎখাত করেছে চরম কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিবাদী নিষ্ঠুর দুঃশাসনকে। রাজধানীসহ সারা দেশের দেওয়ালে দেওয়ালে যে গ্রাফিতি তারা এঁকেছে সেগুলোই সাক্ষী দেবে আমার কথার। অর্থাৎ পৃথিবীতে যতদিন অন্যায় থাকবে, দুঃশাসন থাকবে, শোষকের বিরুদ্ধে লড়াই চলবে ততদিনই ততবারই নজরুল হয়ে উঠবেন বিপ্লবের আত্মার আত্মীয়। কারণ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং নজরুল এক ও অবিভাজ্য সত্তা।
নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব
১. কবিতায় নজরুল যত ছন্দ নিয়ে কাজ করেছেন, অতো কাজ আর কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি।
২. একক কবিতা হিসাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘বিদ্রোহী’ সমতুল্য কবিতা বাংলাভাষা সাহিত্যে নেই। মাত্র ২৩ বছর বয়সে কবি লিখেছেন এই অবিস্মরণীয় কবিতাটি।
৩. বিষয় বৈচিত্র্যে, স্বাদে, গন্ধে, আঙ্গিকে, তাৎপর্যে তার বহুমুখীনতা তুলনাহীন।
৪. সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশবাদ, আধিপত্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, পরাধীনতা, শোষণ, বঞ্চনাবিরোধী সংগ্রামে নজরুলের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। এখানে তার ভূমিকা অগ্রনায়কের। আধুনিকতার নামে উপনিবেশিক ভূসিমাল খেয়ে আত্মহারা তিরিশের দশকের কেরানি কবিদের অবস্থান এক্ষেত্রে কোথায়?
৫. মানুষ, মানবতা, স্বাধীনতার জন্য নজরুলের চেয়ে বেশি কাব্য সফলতা বিশ্ব ইতিহাসে আর নেই।
৬. নজরুল বাংলাভাষার গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃত। তার আগে সাংবাদিকতা ছিল বিগত ফ্যাসিবাদী জামানার মতোই পদলেহী। তার ধূমকেতু ও লাঙলের মতো পত্রিকা আর কখনো প্রকাশ করা যায়নি। এ ধূমকেতুতেই ১৯২২ সালে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে তিনিই প্রথম উপমহাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে জেল-জুলুমসহ অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হন। এটা সেই সময় যখন গান্ধী ও জিন্নাহ সাহেবরা পর্যন্ত স্বাধীনতা শব্দটি উচ্চারণ করতে ভয়ে কাঁপতেন। সেসময় বাংলাভাষার অন্যান্য কবিদের কাউকেই কোথাও দেখা যায়নি।
৭. রবীন্দ্রনাথের নাম মাথায় রেখেই বলব নজরুল উপমহাদেশের সংগীতের সেরা প্রতিভা। তিনি আধুনিক বাংলা গানের জনক। পৃথিবীতে ছিল না, এ রকম ১৮টি নতুন রাগের তিনি স্রষ্টা। তা-ও মাত্র ১০ বছরে। আলাউদ্দিন খান, বেটোফেন কিংবা রবিশংকরের মতো মহৎ সংগীতজ্ঞরা যা পুরো জীবন ব্যয় করেও করতে পারেননি।
৮. বাংলা গজল গানের জনক কাজী নজরুল।
৯. আধুনিক ইসলামি সংগীতের তিনি স্রষ্টা
১০. হীরালাল সেন ও নজরুল আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাণের পথিকৃত। নজরুল বাংলা ভাষার প্রথম কবি যিনি ক্যামেরা ছাড়া চলচ্চিত্রের সব শাখায় উজ্জ্বল অবদান রেখেছেন। এক ডজনের বেশি সিনেমার তিনি কারিগর। এখানে প্রেমেন মিত্র, শৈলজা ছাড়া বাকিদের ভূমিকা শূন্য।
১১. নজরুল অপেরাধর্মী নাটকের পথিকৃত। ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৮০টির মতো নাটক তিনি রেখে গেছেন। আমাদের নাট্যাঙ্গনের লোকজন কখনোই নজরুলের নাটকগুলো ছুঁয়েও দেখেনি। কারণ তাহলে তো আধিপত্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা জুটবে না।
১২. মৃত্যুক্ষুধার মতো উপন্যাস বাংলাভাষায় আদৌ আছে কি?
১৩. ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলাভাষার জনসম্পৃক্ততা ও সহজ স্বাভাবিকতার গতি রোধ করে, দেশের ৮০% মানুষের অধিকারকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে, যে কৃত্রিম ভাষা তৈরি করে বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিল, তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে সফল বিদ্রোহের নায়ক তো নজরুল।
নজরুল শুধু কবি নন, শুধু সংগীতজ্ঞ নন, শুধু আমাদের সাংস্কৃতিক পিতা নন, তিনি আমাদের জাতীয় চেতনার প্রতীক। নজরুল আমাদের সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সুখ-দুঃখের রক্তমাংসের মাটির পৃথিবী। মেহনতি মুক্তিকামী গণমানুষের আত্মা। জসীমউদ্দীন আমাদের নকশী কাঁথার মাঠ। জীবনানন্দ আমাদের রূপসী বাংলার নিঝুম নিসর্গ। আর নজরুল সকল বিবেচনায়ই আমাদের প্রাণের হাজার তারের বীণা।